বিপদকালে ধর্মের রূপ পরিবর্তন হয়


ধর্ম আর আপদধর্ম সম্পূর্ণ এক নয়, কিন্তু ধর্মের সাথেই অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত আছে আপদধর্ম। চরম বিপদকালে ধর্মের রূপ কিছুটা পরিবর্তিত হয়। তাই আপদধর্মের প্রধান উদ্দেশ্যই আত্মরক্ষা, জাতিরক্ষা। দেশে এখন হিন্দুদের জন্যে চরম আপদধর্মকালীন অবস্থা বিরাজ করছে। তাই আমাদের উচিৎ আপাতত বিশ্ব-নাগরিক হবার অবাস্তব কল্পনার জচগতে বিচরণ না করে বাস্তব জগতে জাতি রক্ষার্থে সামান্য হলেও আত্মনিয়োগ করা। নচেৎ আমাদের ভাগ্যাকাশে বর্তমানের থেকেও ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে।

এ সমস্যা সমাধানে সর্বাগ্রে ভূমিকা হওয়া উচিৎ হিন্দু সাধু-সন্তদের। কারণ তারা সবকিছু ত্যাগের মাধ্যমেই ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের প্রবর্তিত ধর্মের শরণ নিয়েছেন, আত্মমুক্তি এবং সর্বজীবের কল্যাণের আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু তারা গদি-বালিসে সুয়ে বসে, এসি গাড়িতে, এসি রুমে থেকে কতটা জীবকল্যাণে কাজ করেন তা আমার কাছে ঠিক পরিষ্কার নয়। আমাদের সাধুদের হাঁটুতে বাতের ব্যথা, ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা। শরীরের ভাঁজে ভাঁজে তাদের প্রতিনিয়ত সমস্যা । অধিকাংশই রোগী, রোগ সেরে গেলে বড়জোর তারা ভোগী হবেন, কিন্তু যোগী কখনোই নয়। মুখে মুখেই শুধুমাত্র কামিনী-কাঞ্চন ত্যাগের লেকচার। যা বাস্তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের জীবনে ছিটেফোঁটা নেই।

হিন্দু সাধুদের দেখলে মনে হয় ধর্মের সাম্যের বাণী প্রচার এবং অবহেলিত মানুষের রক্ষা নয়; সর্বধর্মের ঠিকাদারিই যেন তাদের একমাত্র কাজ। নিজের গায়ে কাপড় নেই, নিজের পরিবারের গায়ে লজ্জা নিবারণের সামান্য কাপড় নেই, এ নিয়ে তাদের কোন সামান্যতম চিন্তা নেই।তাদের চিন্তা শুধুমাত্র লোকদেখানো পৃথিবী উদ্ধার! কিভাবে নিজের সম্প্রদায়ের থেকে টাকা তুলে লোকদেখানো পৃথিবী উদ্ধার করবে এ নিয়েই তাদের যতো চিন্তা। থাকুক না হয় নিজসম্প্রদায়ের ছেলে মেয়েরা উলঙ্গ! তাতে কি আসে যায়! তাদের লোকদেখানো ধর্মের অভিনয় তো চলছে! এরা ভুলে যান শ্রীচৈতন্যের( ১৪৮৬-১৫৩৩) অমোঘ বাণী :

"ভারত ভূমিতে জন্ম হইল যার,
নিজ জন্ম সার্থক করি কর পর উপকার।"

যদি আমার নিজের জন্মই সার্থক না হয়, নিজের অস্তিত্বই না থাকে, নিজের মা-বোনদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে না পারি ;তবে পরের উপকার আমি কি করে করবো বা কেনই করবো? আগে নিজেকে বাঁচতে হবে। আর আপদধর্মকালে আমাদের বেঁচে থাকার পদ্ধতিও আমাদের শাস্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে-
সাম, দান,ভেদ এবং দণ্ড( মহাভারত : আদিপর্ব, ১৩৫ অধ্যায়)। এ কথাগুলো কখনো আমাদের তথাকথিত ধর্মের প্রচারক সাধু-সন্তেরা আমাদের শেখায়নি; শিখিয়েছে শুধু তাদের মতো নপুংসক ক্লীব হয়ে সর্বশেষ দেশান্তরি হতে।

প্রাচীনকালের ঋষি-মুনিরা ছিলেন যোগী, তাঁরা নিয়মিত হঠযোগ-রাজযোগ করতেন। সাধনা করতেন। নিত্য নৈমিত্তিক বৈদিক উপাসনাও করতেন। তাঁদের শরীরে ব্রহ্মতেজের সাথে সাথে যুগপৎভাবে ক্ষাত্রতেজও ছিলো। রাজা- মহারাজারাও তাঁদের কথা মেনে চলতেন, সন্মান করতেন, শ্রদ্ধা করতেন এবং সর্বোপরি ভয়ও পেতেন। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমানের কিছু সাধুসন্তদের দেখলেই মনে হবে এরা নির্দিষ্ট কোন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের ভাড়া করা দালাল। নেতাদের তেল দিতে দিতেই সাধুদের দিন চলে যায়।

সাধুরা গুরুবাদের নামে গ্রাফিক্স ডিজাইন করে পদ্মের উপরে বসে বিভিন্ন সং ভং চং সেজে আদতে হিন্দুসমাজকে ঠকাচ্ছে এবং ধর্মের নামে নিরবচ্ছিন্ন বিনা পুঁজির ধান্দা করে যাচ্ছে। যাদের কাজ ছিল হিন্দু সমাজকে একত্রিত করা, অভয় দেয়া, মার্গদর্শন করা ; উল্টো তারাই ধর্মের উদ্ভট বানোয়াট অপব্যাখ্যা দিয়ে দিয়ে হিন্দুদের দলে দলে বিভ্রান্ত করছে, বিভক্ত করছে। তবে ব্যতিক্রম আছে গুটিকয়েক সৎগুরুরা। সাধু-সন্তদের উচিত অহেতুক সর্বধর্ম সমন্বয়ের গীত গাওয়া বাদ দিয়ে, হিন্দুদের একত্রিত করা। হিন্দুজাতি গঠন করা। আমাদের মনে রাখতে হবে, দূর্বলে সবলে কখনই বন্ধুত্ব হয় না, বন্ধুত্ব হয় দূর্বলে দূর্বলে অথবা সবলে সবলে। দূর্বলে সবলে যদি বন্ধুত্বও হয়, তবে বুঝতে হবে সবল দূর্বলের প্রতি দয়া করছে, করুণা করছে।আর দূর্বলের ক্ষমা প্রদর্শন করা বা না করা একই ; সমাজে এর কোনই মূল্য নেই।

গত দেরশো বছরে বাংলার সাধু-সন্তরা বাঙালি হিন্দুদের যদি সত্যিকারের ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাম্যের শিক্ষা দিতে পারতো তাহলে বাঙালি হিন্দুদের ইতিহাস অন্যপ্রকার হতো। হিন্দুদের আর এভাবে মার খেয়ে, জবাই হয়ে, বাস্তুভিটাচ্যুত হয়ে,উপাস্য দেবতার প্রতিমা ধ্বংস হতে দেখে জনসংখ্যা শূন্যের অভিমুখে যেতে হতো না। তবে স্বামী বিবেকানন্দ, স্বামী প্রণবানন্দ, গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো আরো অনেক সত্যিকারের জাতির আলোক পথের পথিক কিছু সাধু-সন্ন্যাসীরাও আছেন প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা তাঁদের বাণী অনুসরণ করে তাঁদের পথে চলতে পারিনি। আমরা শুধুমাত্র তাঁদের ছবিই দেয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি।

সংগ্রহ-
শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী স্যারের ফেইসবুক পেইজ থেকে।।
প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ

Post a Comment

0 Comments