পঞ্চভূতের যেকোন উপাদানে, প্রতিমা বিসর্জন করা যায়

জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজার একটি বৈশ্বিক খ্যাতি আছে। এ পূজার অন্যতম আকর্ষণ হল চারুকলা অনুষদের পূজাটি। হলের পুকুরের মাঝখানে বৃহৎ আকারের একটি প্রতিমা নির্মাণ করা হয়। অধিকাংশ বছরই প্রতিমাটি ককশিট বা শোলার শিট দিয়ে তৈরি করা হয়। যেহেতু ককশিটের তৈরি প্রতিমা, তাই প্রতিমাটি বিসর্জন দেয়া হয় না। হলের অন্যান্য বিভাগের প্রতিমার মত বুড়িগঙ্গা নদীতে বিসর্জন দিলে দেখা যাবে প্রতিমাটি ওই অবস্থায় বুড়িগঙ্গা নদী থেকে জেলার পরে জেলা ভেসে বেড়াবে।কৃত্রিম উপাদানে তৈরি হওয়ায় এটি অন্যান্য প্রতিমার মত প্রকৃতির সাথে মিশে যায় না।খড়, কাঠ, বাঁশ, বেত
ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদানে চারুকলা অনুষদের প্রতিমাটি তৈরি করতে বিভিন্ন সময়ে হল প্রশাসন সহ অনেকেই তাদের বলেছে। আমি যখন ছাত্র ছিলাম প্রাকৃতিক উপাদানে প্রতিমাটি তৈরি করতে চারুকলার অনেক অগ্রজ দাদাদের বলেছি এবং ব্যক্তিগতভাবে হলের প্রাধ্যক্ষকে অনুরোধ করেছি বিষয়টি দেখতে। এমন উপাদানে প্রতিমা বানাতে যাতে প্রতিমা বিসর্জন দিয়ে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে দেয়া যায়। সরস্বতী পূজা থেকে মাসখানেক পুকুরের মাঝখানে চারুকলার প্রতিমাটি অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন অবস্থায় থাকে। এরপরর রোদ বৃষ্টি এবং ঝড়ে আস্তে আস্তে ক্ষত-বিক্ষত হতে থাকে। বিষয়টি একটি সময়ে গিয়ে বেশ দৃষ্টিকটুও দেখায়। পরিশেষে গীত শেষে অবহেলিত ধুলাবালিতে গড়াগড়ি দেয়া বীণার মত অবস্থা হয় প্রতিমাটির।

আমাদের শরীর ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম এ পাঁচটি উপাদানে গঠিত।তাই আমাদের শরীরকে পাঞ্চভৌতিক শরীর বলে। মাটি, জল, আগুন, বাতাস এবং শূণ্য এ পাঁচটি উপাদানে যেহেতু আমাদের শরীর উৎপন্ন।তাই মৃত্যুর পরে আমাদের শরীরকে এ পাঁচটি উপাদানেই সমর্পণ করা হয়। অর্থাৎ যে যে উপাদানে শরীরটি গঠিত, সেই সেই উপাদানে পুনরায় সমর্পণ করে তাদের সাথে মিলিয়ে দেয়া। এ কারণেই মৃত্যুর পরে আমাদের শরীরকে অগ্নিতে আহুতি দেয়া হয়। অগ্নিতে দেহটি পুরে গিয়ে অগ্নির সাথে তো বটেই, ক্ষুদ্র ছাইয়ের কণা হয়ে কিছু অংশ বাতাসের সাথে মিশে যায়। অন্তেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পরে, কয়লা এবং ছাইয়ে রূপান্তরিত দেহটিতে মাটি এবং জলে দিয়ে দেয়া হয়। কিছু অংশ বাসাতের সাথে আকাশে মিশে যায়। দেহকে অগ্নি সংস্কার করা হয় এ কারণেই যাতে প্রাকৃতিক পঞ্চ উপাদানে গঠিত শরীরটি পঞ্চ উপাদানের সাথে মিলে যায়। মৃতদেহটিকে আগুনে দাহ না করে জলেও সলিলসমাধি দেয়া যায়।মাটিতেও সমাধি দেয়া যায়। আবার নশ্বর দেহটিকে পশুপাখিদের ভোজনের জন্যে উঁচু স্থানেও ফেলে রাখা যায়। অগ্নি, মাটি, জলের মত তখন বাতাসে দেহটি সমর্পিত হয়।

একইভাবে পুরাতন দেববিগ্রহও এ পঞ্চভূতে সমর্পণ করতে হয়। তবে প্রচলিত সংস্কারবশত আমরা শুধু জলেই প্রতিমা বিসর্জন দেই। তবে লক্ষ্মী, সরস্বতী সহ কয়েকটি বিগ্রহ আমরা বাঙালিরা জলে বিসর্জন না দিয়ে বেলগাছ, অশ্বত্থগাছ সহ যে কোন গাছতলায় রেখে আসি। খোলা গাছতলায় থেকে বৃষ্টিতে ভিজে ধীরেধীরে প্রতিমাটি মাটির সাথে মিশে যায়। আমারা জলে তো প্রতিমা বিসর্জন দেই, এরসাথে মাটি, বাতাস, আকাশেও প্রতিমা বিসর্জন দেই। পঞ্চভূতের মধ্যে অগ্নি একটি অত্যন্ত পবিত্র ভূত বা উপাদান। ঋগ্বেদ সংহিতা প্রথম শব্দই অগ্নি। অগ্নি অত্যন্ত পবিত্র এবং দেবতাদের মুখ বলা হয়েছে। তাই অগ্নির মাধ্যমেই দেবতারা যজ্ঞের হবি গ্রহণ করেন।

বর্তমানে ককশিট, ফাইবার সহ এমন অনেক কৃত্রিম উপাদানে প্রতিমা তৈরি করা হয় যা, জলে বিসর্জিত হলেও জলের সাথে মিশে যায় না। এ সকল উপাদানে প্রতিমা তৈরি করা অশাস্ত্রীয়। শ্রীমদ্ভাগবত সহ একাধিক শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া আছে প্রতিমা কেমন ধরণের উপাদানে তৈরি হবে। উপাদানগুলো অবশ্যই মাটি, কাঠ, পাথর, রত্ন এবং ধাতু সহ প্রাকৃতিক উপাদানের হতে হবে। প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি হতে হবে, এ কারণেই, যাতে প্রতিমাটি পরিবেশের কোন ক্ষতি না করে প্রকৃতিক সাথেই মিশে যেতে পারে।জীর্ণ পুরাতন প্রতিমা পঞ্চভূতে মিলিয়ে দিতে হবে, সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দেবীপুরাণে বর্ণিত আছে। দেববিগ্রহ যদি মাটি বা পাথরের হয় তবে গভীর জলে নিয়ে গিয়ে সে প্রতিমাকে বিসর্জন দিতে হবে।পক্ষান্তরে কাঠ সহ যে সকল উপাদানের প্রতিমা জলে ভেসে থাকে; তাদের ঘি মাখিয়ে অগ্নিতে সমর্পণ করতে হবে।

ক্ষীরবৃক্ষসমিদ্ধন্তু হুত্ব্যা দার্বীং দহেদ্বিভো।
শৈলং মহাম্ভসি ক্ষিপ্ত্বা তদা চান্যৎ নিবেশয়েৎ ॥ 
(দেবীপুরাণ :১১৮ অধ্যায়, ১২)

" পুরাতন জীর্ণমূর্তি কাষ্ঠময় হলে, ক্ষীর-বৃক্ষাগ্নিতে নিক্ষেপ পূর্বক দগ্ধ করবে। প্রস্তরময় হলে গভীর জলে নিয়ে গিয়ে বিসর্জন দিবে। পরে অন্য একটি নতুন মূর্তি, সেই মন্দিরে স্থাপন করবে। "

আমাদের হিন্দুদের কোন মন্দির বা প্রতিমা তৈরি করে পূজা শুরু করলে প্রথমে থাকে প্রচণ্ড আগ্রহ, সাধ্যমত সুন্দর করে করতে চাই। প্রচেষ্টার কোন কমতি থাকে না। এরপরে আগ্রহ থেকে হয় নিজেদের মধ্যে জন্ম নেয় বিভিন্ন উপগ্রহ। অর্থাৎ মন্দির কমিটি, পূজা কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে শুরু হয়ে যায় বিভিন্ন গোষ্ঠী কোন্দল বা গ্রুপিং। শুরুর ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় আস্তেধীরে ভাটা পড়তে থাকে। উপগ্রহগুলো ধীরেধীরে যুদ্ধবিগ্রহে রূপ নেয়। অশান্তির কোন কিছুই আর কমতি থাকে না। শেষে সকলেই হতাশ হয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।তখন এ মহৎ উদ্দেশ্যগুলো এক একজনের গলগ্রহ হয়ে যায়। গলার কাঁটা হয়ে যায়। কাঁটাগুলো গলা থেকে গিলতেও পারে না, তুলে ফেলতে পারে না। আগ্রহ শেষে গলগ্রহতে এসে থামে।

বর্তমানে পূজার প্যান্ডেলে প্রচুর অস্থায়ী ককশিটের দেবদেবীর মূর্তি তৈরি করা হয়। পূজার পরে, যখন পূজার প্যান্ডেল ভেঙে ফেলা হয়, তখন এ প্রতিমাগুলো ধুলায় অবহেলায় গড়াগড়ি যায়। বিষয়টি দুঃখজনক এবং লজ্জার। বর্তমানে অধিকাংশ ধূপকাঠির প্যাকেটে দেবদেবীর ছবি থাকে। ধূপকাঠি শেষ হয়ে যাওয়ার পরে দেবদেবীর ছবিযুক্ত প্যাকেটটি অবহেলায় রাস্তায় পরে থাকে।বিষয়টি প্রচণ্ড দৃষ্টিকটু দেখায়। পূজা এবং বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষে দেবদেবীদের ছবি দিয়ে অসংখ্য ডিজিটাল পলিমার ব্যানার তৈরি করা হয়।এ ব্যানারগুলোরও দশা হয় ধূপকাঠির প্যাকেটের মত। কিন্তু যে সকল অপচনশীল উপাদানে দেবদেবীর মূর্তি এবং ছবি থাকে, সে অপচনশীল উপাদানগুলোকে অগ্নিতে সমর্পণ করতে। যার নির্দেশ শাস্ত্রেই আছে। অন্ততপক্ষে দেবদেবীর মূর্তিগুলো, ছবিগুলো রাস্তায়, পদধূলিতে পদদলিত হয়ে অসম্মানজনক পরিণত বরণ করার থেকে তাদের সম্মানের সাথে পঞ্চভূতের যে কোন একটি উপাদানে বিসর্জন দেয়া কর্তব্য। জলে বিসর্জন দেয়া সর্বোত্তম। তবে কৃত্রিম উপাদানে তৈরি প্রতিমা জলা বিসর্জন দেয়া সম্ভব না হলে অবহেলায় ফেলে না রেখে অগ্নিতেও বিসর্জিত করা যায়। বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে দৃষ্টিকটু হলেও, শাস্ত্রসম্মত। 

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments