অদ্ভুত আঁধারের এক,যুগান্তকাল চলছে পৃথিবীতে

মহাভারতের আদিপর্বে মহারাজ পাণ্ডুর আকস্মিক মৃত্যুতে হস্তিনাপুরে এক তীব্র শোকের ছায়া কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘিরে ধরলো। ব্যাসদেব তাঁর শোকসন্তপ্ত মা সত্যবতীকে সান্ত্বনা দিতে হস্তিনাপুর আসলেন। তিনি দেখলেন পুরবাসী ও দেশবাসী লােকেরা নিজ আত্মীয় পরিজনের মৃত্যু শোকের মতই পুরুষশ্রেষ্ঠ পাণ্ডুর জন্যে শােক প্রকাশ করছে। ব্যাসদেব শােকে পীড়িতা এবং মূর্চ্ছিতপ্রায়া মাতা সত্যবতীর কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি মা সত্যবতীকে জানালেন, সুখের দিন সব চলে গেছে, আগামী দিনে ভয়ংকরভাবে ক্রমশই পাপের বৃদ্ধি হবে। এর ফলে পৃথিবী দিনেদিনে গতযৌবনা হয়ে যাবে।তাই ব্যাসদেব তাঁর মা সত্যবতীকে হস্তিনাপুর নগর ছেড়ে তপবনে চলে যেতে বললেন। কারণ পৃথিবীর এ ভয়ংকর আকস্মিক পরিবর্তন, হঠাৎ করে তার ভাল লাগবে না। আকস্মিক পরিবর্তন সে সহ্য করতে পারবে না। নিজের চিরচেনা চারপাশের পৃথিবী যখন হঠাৎ পরিবর্তন হয়, তখন মানুষ সহজেই তা মেনে নিতে পারে না। প্রচণ্ড মানসিক কষ্ট হয়।

শ্রদ্ধাবান তু তদা দৃষ্ট্বা তং দুঃখিতং জনম্। 
সম্মূঢ়াং দুঃখশােকার্তাং ব্যাসাে মাতরমব্রবীৎ॥ অতিক্রান্তসুখাঃ কালাঃ পর্য্যুপস্থিতদারুণাঃ। 
শ্বঃ শ্বঃ পাপিষ্ঠদিবসাঃ পৃথিবী গতযৌবনা ॥ বহুমায়াসমাকীর্ণো নানাদোষসমাকুলঃ। লুপ্তধর্মক্রিয়াচারাে ঘােরঃ কালো ভবিষ্যতি ॥ কুরূণামনয়াচ্ছাপি পৃথিবী ন ভবিষ্যতি । 
গচ্ছ ত্বং যােগমাস্থায় যুক্তা বস তপোবনে॥

(মহাভারত :আদিপর্ব, ১২২ অধ্যায়,৫-৮)

"তখন বেদব্যাস সেই সকল লােককে দুঃখিত দেখে, দুঃখে ও শােকে পীড়িতা এবং মূর্চ্ছিতপ্রায়া মাতা সত্যবতী কে বললেন-
“মা! সুখের দিন সব চলে গেছে, এখন ক্রমশই ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটবে। পূর্বের দিন অপেক্ষা আগামী দিনে অধিক পাপ বৃদ্ধি হবে। পাপের বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী দিনেদিনে গতযৌবনা হয়ে যাবে।
ভয়ঙ্কর কাল আসছে, লােকসমাজ নানা দোষে কলুষিত হবে, সমস্ত ধর্মকার্য ও সর্বপ্রকার সদাচার লােপ পাবে এবং মানুষকে আগামীতে বহুকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করে বেঁচে থাকতে হবে।

এবং কৌরবগণের দুর্ব্যবহারে পৃথিবী আর সুস্থ থাকিবে না। হে মাতা! আপনি যােগ অবলম্বন করার সঙ্কল্প করে তপোবনে গমন করুন। সেখানে গিয়ে যােগ অবলম্বন করে অবস্থান করুন।"

পৃথিবীর আকস্মিক পরিবর্তন দেখে সত্যবতীকে তাঁর পুত্র বনে চলে যেতে বলেছেন। পুত্রের কথামত সত্যবতী তপবনে চলে গিয়ে, পরবর্তী জীবন সেখানেই অতিবাহিত করেন। কিন্তু আমরা বর্তমানের তথাকথিত মানুষেরা যাব কোথায়, পরিশেষে আশ্রয় নিব কোথায়? নগরায়ণ শিল্পায়নের চাকায় পিষ্ট হয়ে বনভূমি শেষ হয়ে যাচ্ছে। ধীরেধীরে পৃথিবীটা কেমন যেন অচেনা হয়ে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে, বিগতযৌবনা হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর সাথে সাথে আমরাও পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছি। হয়ত পৃথিবী মহাজাগতিকভাবে একইরকম আছে, কিন্তু মানব সমাজ এবং সভ্যতার নিষ্ঠুর পরিবর্তনে জগত আমাদের কাছে পরিবর্তিত বোধ হচ্ছে। জগতের সকল কিছুই আপেক্ষিক, প্রত্যেকটি বিষয় আবর্তিত হয় নিজ চিন্তাধারা দ্বারা। জগতে প্রত্যেকটি ব্যক্তি তার চিন্তাধারাই স্বতন্ত্র। জগতের পরিবর্তন ধীরেধীরে আসে। কিন্তু প্রযুক্তির কল্যাণে পরিবর্তনগুলো যেন খুব দ্রুতই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চলে আসছে। স্বতন্ত্র এক একটি মানব স্বার্থপরতার ক্ষেত্রে, আত্মঘাতী হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে, ক্ষমতা লাভার্থে, পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংসে ইত্যাদি অধর্মে একই আচরণ করছে।বিষয়টি বিস্ময়কর, এর অভিঘাতে জগত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে বিগতযৌবনা হয়ে যাচ্ছে। জগতের পরিবর্তন ধীরেধীরে হয়।কিন্তু এ বৈশ্বিক এ পরিবর্তন দ্রুতই আমাদের বসতবাড়ি সহ মনজগতে মূর্তিমান হয়ে যাচ্ছে। এ পরিবর্তনকে যুগান্তকাল বলে।

ব্যাসদেব তাঁর মা সত্যবতীকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, পাপের বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী দিনেদিনে গতযৌবনা হয়ে যাবে। অর্থাৎ পৃথিবী তাঁর সকল সৌন্দর্য যৌবন হারিয়ে ফেলবে। এর সাথে সাথে এক ভয়ঙ্কর যুগান্তকালের আগমন ঘটবে। লােকসমাজ নানা দোষে কলুষিত হয়ে সমস্ত ধর্মকার্য পরিত্যাগ করবে। লোকদেখানোর স্বার্থে করবে।সর্বপ্রকার সদাচারও লােপ পাবে। মানুষকে বেঁচে থাকতে আগামীতে বহুকষ্টে জীবিকা নির্বাহ করতে হবে।

যুগান্তকাল বহু সময়ের আবর্তনে আসে। কিন্তু গত কয়েকটি শতকে আমরা পৃথিবীর এত পরিবর্তন হতে দেখেছি যে ; এক একটি শতাব্দী যেন এক একটি যুগান্তকাল। বিংশ শতাব্দীতে দুটি বিশ্বযুদ্ধ সহ অসংখ্য দেশের কৃত্রিম বিভাজন, সর্বগ্রাসী মহামারীতে যে কত মানুষ নিহত হয়েছে এর সঠিক পরিসংখ্যান কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। শুধু অনুমানের ভিত্তিতে পরিসংখ্যানটিও বৃহৎ। ভানুমতীর ইন্দ্রজালের মত বিজ্ঞান প্রযুক্তির অগ্রগতিতে পাল্টে গিয়েছে আমাদের সমাজ, সভ্যতা এবং ব্যক্তিমনজগত। বিজ্ঞান প্রযুক্তির অভাবনীয় অগ্রগতি প্রসঙ্গে মনে পরে, স্কুলে আমাদের সহকারী প্রধান শিক্ষক মোশারফ স্যার ক্লাসে মাঝেমধ্যে বলতেন-এমন দিন আসবে মানুষ হাতে টেলিভিশন নিয়ে রাস্তায় ঘুরবে। হাটবে আর টেলিভিশন দেখবে। আমরা আবাক হয়ে কথাগুলো শুনতাম। শিশুমনে ভাবতাম, হাতে টেলিভিশন এটা কি করে হবে? এটা তো অসম্ভব। কিন্তু সেই চরম অসম্ভবকে সম্ভব হতে আমি আমার এই জীবনেই দেখলাম। আজ আমরা হেটে বেড়াতে বেড়াতে ইউটিউবে টেলিভিশন চ্যানেলের সকল প্রোগ্রাম লাইভ দেখতে পারি। জানিনা আগামীতে প্রযুক্তির আমরা আর কত ভানুমতীর ইন্দ্রজাল দেখব। তবে এতটুকু উপলব্ধি করতে পারি প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ যত বাড়ছে;ততই আমাদের কৃত্রিমতা বাড়ছে। যান্ত্রিকতা বাড়ায় জীবনে যেমন গতি এসেছে; ঠিক তেমনি মনুষ্যত্ববোধ ধীরেধীরে তলানিতে চলে যাচ্ছে। আমরা ঠিক বুঝতে পারছি না, আমরা কি এগিয়ে যাচ্ছি, নাকি এগিয়ে যাওয়ার নামে পৃথিবীকে ক্ষত-বিক্ষত করে আরও পিছিয়ে পড়ছি। সভ্যতার সঙ্কট ধীরেধীরে তীব্র হচ্ছে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মত। নাগরিক জীবনের ভোগসর্বস্বতা আমাদের আরও আত্মকেন্দ্রিক পাগল করে তুলছে।বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি। তাঁর 'চৈতালী' কাব্যগ্রন্থে 'সভ্যতার প্রতি' কবিতায় তিনি কৃত্রিম লোহা, কাঠ এবং পাথরের নাগরিক জীবনকে ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ করেছেন। বিনিময়ে তিনি পূর্বের সেই সবুজ অরণ্যকে চেয়েছেন। 

"দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
দাও সেই তপোবন পুণ্যচ্ছায়ারাশি,
গ্লানিহীন দিনগুলি, সেই সন্ধ্যাস্নান,
সেই গোচারণ, সেই শান্ত সামগান,
নীবারধান্যের মুষ্টি, বল্কলবসন,
মগ্ন হয়ে আত্মমাঝে নিত্য আলোচন
মহাতত্ত্বগুলি। পাষাণপিঞ্জরে তব
নাহি চাহি নিরাপদে রাজভোগ নব-
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।"

আস্তে-ধীরে বন ধ্বংস হয়ে তার বুকের উপরে শহর যেমন চেপে বসছে। তেমনি মানুষের মনও ইট, কাঠ, পাথর, লোহার মত হয়ে যাচ্ছে। সেই কোমলতা, সেই স্নিগ্ধতা ফুরিয়ে যাচ্ছে আজ।শুধু সাহিত্যেই তার দেখা মেলে। পরাধীন পাষাণপিঞ্জরে বসে রাজভোগ খেতে চাই আমরা। কিন্তু স্বাধীন হৃদয়ে দুমুঠো ডালভাত যে এর থেকেও অমৃতমত তা আমাদের ভেবে দেখার সময় নেই। শুধুই ছুটছি আর ছুটছি আমরা। কে কার আগে যেতে পারি। কে কাকে দৌড়ে হারাতে পারি, এই চিন্তা। এ নিরবচ্ছিন্ন চাওয়া পাওয়ার রেস থেকে একটু যদি ধাতস্থ হতে পারি, তবে দেখতে পাব যুগান্তরের এ ভয়াবহকালের স্বরূপ। একটি ক্ষুধার্থ পেট যে শিক্ষা দেয়, পৃথিবীর অন্য কোন কিছুই সে শিক্ষা দিতে পারবে না।জগত পরিবর্তিত হচ্ছে, সাথে আমরাও পরিবর্তিত হচ্ছি।এর থেকে পালিয়ে আমরা বাঁচতে পারব না। 

বর্তমান যুগান্তকালে প্রতিদিন যে কত শতসহস্র নারী ধর্ষিত হচ্ছে তার খবর নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিকার নেই, বিচার নেই। মহাভারতে দৃষ্টান্ত, গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, আর্যাবত্যের শ্রেষ্ঠ গুরু দ্রোণাচার্য, সূর্যপুত্র কর্ণের মত মহাপ্রতাপশালীরা থাকার পরেও তাঁরা কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে হেরে গিয়েছিল। তাদের গরিমা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল শুধু এক দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণে। তবে আজকের দুর্যোধন দুঃশাসনরা পূর্বের থেকে অনেক শক্তিশালী। পূর্বে তাদের হাতে শুধুই ক্ষমতা ছিল, আজ তাদের হাতে ক্ষমতার সাথে আছে প্রযুক্তি, আছে মিডিয়া, আছে অর্থ। এ এক অন্ধকার জগতে পথহারা হয়ে হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমরা। পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ধর্ম ধর্মমোহের রূপ ধারণ করে মানুষের মস্তিষ্ককে আত্মঘাতী করে তুলছে। অন্ধধর্মমোহ এবং পরকালের মোহে, লোভে নিজে আত্মঘাতী হয়ে অন্য নিরপরাধ মানুষকে নির্দ্বিধায় মেরে ফেলছে। জগতে ধর্মের নামে বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসী এই দুইপ্রকারে ভাগ করে তথাকথিত অবিশ্বাসীদের প্রতি চলছে ঘৃণার প্রচারণা। চিরচেনা পৃথিবীর এমন অদ্ভুত আঁধার এবং অদ্ভুত আচরণে কবি জীবনানন্দ দাশের একটি কবিতা মনে পড়ে।

"অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব'লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।"

সভ্যতা সংস্কৃতি প্রচণ্ড গতিতে চলতে গিয়ে আজ থমকে যাচ্ছে। পথহারা হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর মুক্ত আকাশে পাখিদের স্বাধীনতা থাকলেও মানুষের নেই। দেশগুলো ভাষার নামে, ধর্মের নামে এমনভাবে খণ্ডিত হচ্ছে, তাদের মানচিত্রের দিকে তাকালেই মনে হয়, সোজা একটি স্কেল রেখে দেশগুলোকে বিভাজন করা হয়েছে। আফ্রিকা মহাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি বেশি চোখে পরে।অথচ একটি দেশ থেকে অন্যদেশের সীমান্ত নির্ধারিত হওয়ার কথা প্রাকৃতিকভাবে।১৯৪৭ সালে বাংলা যখন বিভক্ত হয়েছে, তখন অনেকটা এভাবেই হয়েছে। কারো বসতঘর পড়েছে ভারতে এবং রান্নাঘর পরেছে পাকিস্তানে। বসতবাড়ির মধ্য দিয়েই চলে গেছে দুইদেশের সীমানা। প্রতি শতকে শতকে পরিবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর রূপ-রস-গন্ধ। পূর্বের সেই স্নিগ্ধ শান্ত রূপই কল্যাণকর ছিল।প্রযুক্তি পৃথিবীর মানুষকে একজন থেকে অন্যজনকে কাছে আনাতে গিয়ে ; তাদের মনজগতে আরও যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রিয়জনেরা এক বিছানায় অর্ধশতাব্দী বাস করেও, একজন অন্যজন থেকে পরবাসী।চোখের সামনে দেখে শুনেও একজন অন্যজনের মনের ভূগোল যথাযথ পাঠ করতে পারে না।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments