শ্রীমদ্ভাগবতের বিবিধ স্থানে, আদ্যাশক্তি দুর্গার মাহাত্ম্য বর্ণিত

আদ্যাশক্তি মহামায়ার স্বতন্ত্র উপাসনা পদ্ধতি, যাকে শাক্তমত বলে, সেই সকল স্থানে একটি সাধারণ বিষয় পাওয়া যায় ; তা হল বলি। শাক্তমতের সাথে বলি অবিচ্ছেদ্যভাবে আছে।তাই দেবীকে 'বলিপ্রিয়া' বলা হয়। সকল জীবকে তিনিই সৃষ্টি করেন আবার তিনিই বিনাশ করেন। বলি বিষয়টি শাক্তশাস্ত্রের সাথেসাথে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রধানতম গ্রন্থ শ্রীমদ্ভাগবতেও দেখা যায়। সেখানে একাধিকবার দেবীকে বলি প্রদান করে পূজা করার কথা বলা আছে। আজ আমরা অনেকেই, বিশেষ করে বাঙালি হিন্দুরা কৃষ্ণ এবং আদ্যাশক্তিকে আলাদা বলে মনে করি। কিন্তু শাস্ত্র কিন্তু তা বলে না। শাস্ত্রে আছে যিনি কৃষ্ণ, তিনিই কালী। শ্রীমদ্ভাগবতের পঞ্চম স্কন্ধেও কৃষ্ণ-কালীর অভেদ বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে বর্ণনা করা আছে।

ন বা এতদ্বিষ্ণুদত্ত মহদদ্ভুতং যদসম্ভ্রমঃ 
স্বশিরশ্চ্ছেদন আপতিতেঽপি বিমুক্ত-
দেহাদ্যাত্মভাবসুদৃঢ়হৃদয়গ্রন্থীনাং সর্বসত্ত্ব-
সুহৃদাত্মনাং নির্বৈরাণাং সাক্ষাদ্ভগবতা-
নিমিষারিবরায়ুধেনাপ্রমত্তেন তৈস্তৈর্ভাবৈঃ 
পরিরক্ষ্যমাণানাং তৎপাদমূলমকুতশ্চি-
দ্ভয়মুপসৃতানাং ভাগবতপরমহংসানাম্ ॥
(শ্রীমদ্ভাগবত : ৫.৯.২০) 

"ভগবান স্বয়ং ভদ্রকালী প্রভৃতি বিভিন্ন রূপ ধারণ করে এসে সাধুদের রক্ষা করেন। যার দেহাভিমানরূপ হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়ে গেছে, যিনি সমস্ত প্রাণীজগতের সুহৃৎ, যিনি কারাের প্রতি বৈরী ভাব পােষণ করেন না, তাদের স্বয়ং ভগবান বিভিন্ন রূপ ধারণ করে রক্ষা করেন ; তাই ভগবানের শরণাগত নির্ভয় ভগবদ্ভক্ত পরমহংসগণ নিজের শিরচ্ছেদনের সময়েও বিচলিত হবেন না, এটাই স্বাভাবিক।"

শ্রীমদ্ভাগবত, বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মপুরাণ আদি বিবিধ পুরাণে দেবী যোগমায়ার কথা উল্লেখ আছে। আদ্যাশক্তি দেবী দুর্গাই হলেন, যোগমায়া। তিনি হলেন অঘটনঘটনপটীয়সী ভগবানের সক্রিয় লীলাশক্তি। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবের সময়ে ভগবান তাঁর প্রকৃতি স্বরূপা লীলাশক্তিকে গোকূলে নন্দরাজ এবং যশোদার গৃহে জন্মগ্রহণ করতে বলেন। মার্কণ্ড পুরাণের অন্তর্গত শ্রীচণ্ডীতেও দেবীর দৈত্যবিনাশের অভয়বাণীতে তিনি নিজমুখে উল্লেখ করেন যে , তিনি দ্বাপরে যশোদা গৃহে জন্ম গ্রহণ করবেন। ভগবানের পৃথিবীতে অবতার রূপে অবতীর্ণ হওয়ার পূর্বে দেবীর সাথে একটি কথোপকথন শ্রীমদ্ভাগবতে দেখা যায়। সেখানে ভগবান বলেন:

অথাহমংশভাগেন দেবক্যাঃ পুত্রতাং শুভে ।
প্রাপ্স্যামি ত্বং যশোদায়াং নন্দপত্ন্যাং ভবিষ্যসি ।।
অর্চিষ্যন্তি মনুষ্যাস্ত্বাং সর্বকামবরেশ্বরীম্‌ ।
ধূপোপহারবলিভিঃ সর্বকামবরপ্রদাম্‌ ।।
নামধেয়ানি কুর্বন্তি স্থানানি চ নরা ভুবি ।
দুর্গেতি ভদ্রকালীতি বিজয়া বৈষ্ণবীতি চ ।।
কুমুদা চণ্ডিকা কৃষ্ণা মাধবী কন্যকেতি চ ।
মায়া নারায়নীশানী শারদেত্যম্বিকেতি চ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১০ স্কন্ধ, ২য় অধ্যায়,৯-১২)

" ভগবান বললেন, হে কল্যাণী! আমি জ্ঞান- বলাদি দ্বারা সর্বাংশে পরিপূর্ণভাবে দেবকীর পুত্ররূপে অবতীর্ণ হব এবং তুমিও নন্দরাজের পত্নী যশোদার গর্ভে অবতীর্ণ হবে। 

তুমি সর্বলোকের সকলের প্রার্থনাপূরণকারিণী বরদাদেবীরূপে পূজিতা হবে। লোকে ধূপ-প্রদীপ- উপহার- বলি দ্বারা সকল মনোবাঞ্ছা পূরণের জন্যে তোমার পূজা করবে।

পৃথিবীতে বিভিন্ন স্থানে মানুষেরা তোমার পীঠাদি স্থাপন করবে এবং দুর্গা, ভদ্রকালী, বিজয়া, বৈষ্ণবীশক্তি, কুমুদা, চণ্ডিকা, কৃষ্ণা, মাধবী, কন্যা, মায়া, নারায়ণী, ঈশানী, শারদা, অম্বিকা প্রভৃতি অসংখ্য নামে তোমার পূজা করবে।"

জগতের সৃষ্টিকর্তা যিনি ব্রহ্ম, তিনিই শক্তি। যিনি পুরুষ তিনিই প্রকৃতি। এ জগতজুড়ে রয়েছে আদ্যাশক্তি মহামায়ার রূপের প্রকাশ। কখনও দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে তিনি 'দুর্গা' নামে খ্যাত। তিনিই মঙ্গলময়ী কালের অধিষ্ঠাত্রী, তাই তার নাম 'ভদ্রকালী'। তিনিই সকল কার্যে বিজয় দান করেন, তাই তাঁর নাম 'বিজয়া'। তিনি ভগবান বিষ্ণুর জগত পালনের স্থিতিশক্তি, তাই তাঁর নাম 'বৈষ্ণববীশক্তি'। তিনিই পদ্মসদৃশ মহালক্ষ্মী, তাই তাঁর নাম 'কুমুদা'। তিনিই চণ্ডমুণ্ডের বিনাশকারিনী দেবী 'চণ্ডিকা'। তিনিই প্রলয়ের তামসীশক্তি কৃষ্ণবর্ণের 'কৃষ্ণা'। তিনিই সর্বকার্যে স্মর্তব্য, মাধবের শক্তিস্বরূপা 'মাধবী'। তিনিই 'কন্যা' রূপিণী জীবের দুর্গতি বিনাশকারিনী কন্যাকুমারী আখ্যাতা দুর্গা। তাঁর মায়াতেই জগত মোহিত, তিনিই জীবকে মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করেন, আবার তিনিই সেই বন্ধন থেকে মুক্ত করেন; তাই তাঁর নাম 'মহামায়া'। তিনি নারায়ণের শক্তি 'নারায়ণী' এবং ঈশান শিবের শক্তি 'ঈশানী'। তিনিই শরৎকালে মহাসমারোহে পূজিতা 'শারদা' রূপধারিণী মহিষাসুরবিধ্বংসী দেবী দুর্গা। তিনিই জগতের মাতা জগন্মাতা 'অম্বিকা'।

ভাদ্রমাসের রোহিনী নক্ষত্রের জন্মাষ্টমীর রাত্রে ভগবান অবতার রূপে অবতীর্ণ হলেন কংসের কারাগারে। দেবী যোগমায়া আবির্ভূতা হলেন গোকূলে নন্দ-যশোদার গৃহে। যশোদা বুঝতেও পারেনি, যে দেবী আবির্ভূতা হয়েছেন। দৈব নির্দেশে বসুদেব গোকূলে শিশু শ্রীকৃষ্ণকে রেখে কন্যাকে নিয়ে আসেন মথুরায় কংশের কারাগারে। সেই কন্যাকে দেখে দেবকী, বসুদেব ভাবলেন একেই আশ্রয় করে বাকী জীবন কাটাবেন। দৈববাণী মতে অষ্টম পুত্র কংসের কাল হবে। কন্যা ত নয়। কিন্তু দুর্মতি কংস ভাবল, ভগবান মোহিনী রূপ ধরে অসুরদের ছলনা করেছেন। হয়তো এবারও ছল আশ্রয় করেছেন । কন্যাটিকে হত্যা করতে গেলে দেবকী অনুনয়- বিনয় করে বুঝিয়ে বলল- ভ্রাতা স্ত্রীহত্যা জঘন্য কাজ। এই কন্যা স্ত্রীজাতীয়া। এমন করা তোমার উচিৎ না। তুমি আমার অনেক গুলি অগ্নিতুল্য তেজস্বী সন্তানকে নষ্ট করেছ। এই একটি আমার জীবিত কন্যা সন্তান। একে ছেড়ে দাও। আমি তোমারই বোন। এতগুলি সন্তান হারিয়ে আমি শোকে দুঃখে কাতর। তুমি ক্ষমতাশালী, শৌর্যবান। আমার এই সন্তানকে নষ্ট করো না। কিন্তু কংস কিছুই শুনলো না। অট্টহাস্য করে কন্যাটিকে নিয়ে পাথরে আছার মেরে বধ করতে গেলে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। দেবী দিব্য মালা, বস্ত্র, অলঙ্কারে সুশোভিতা হয়ে অষ্টাভুজা শূণ্যে আবির্ভূত হলেন।

সা তদ্ধস্তাৎ সমুৎপত্য সদ্যো দেব্যম্বরং গতা ।
অদৃশ্যতানুজা বিষ্ণোঃ সায়ুধাষ্টমহাভুজা ।।
দিব্যস্রগম্বরালেপরত্নাভরণভূষিতা ।
ধনুঃশূলেষুচর্মাসিশঙ্খচক্রগদাধরা ।।
সিদ্ধচারণগন্ধর্বৈরপ্সরঃকিন্নরোরগৈঃ ।
উপাহৃতোরুবিলিভিঃ স্তূয়মানেদমব্রবীৎ ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১০ স্কন্ধ,চতুর্থ অধ্যায়, ৯-১১)

"কংসের হাত থেকে ছিটকে শূন্যে উঠে কন্যাটি দেবীরূপ ধারণ করলেন। তিনি অষ্টাভুজা। তিনি দিব্য মালা, বস্ত্র, অলঙ্কারে সুশোভিতা। আট হাতে ধনুক, শূল, বাণ, ঢাল, তরোয়াল , শাঁখ, চক্র ও গদা শোভা পাচ্ছিল। সেই অষ্টভুজা মহাদেবীকে সিদ্ধ, চারণ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, কিন্নর, নাগেরা বহুবিধ বলি- উপহার- সামগ্রী দিয়ে পূজা ও স্তুতি করছিলেন।"

কংস দেখে অবাক। স্বয়ং দেবকী , বসুদেব করজোড়ে মহামায়াকে বন্দনা করছিলেন। দেবী বললেন:

কিং ময়া হতয়া মন্দ জাতঃ খলু তবান্তকৃৎ ।
যত্র ক্ক বা পূর্বশত্রুর্মা হিংসীঃ কৃপণান্‌ বৃথা ।।
( শ্রীমদ্ভাগবত: ১০ স্কন্ধ,চতুর্থ অধ্যায়,১২)

"দেবী বললেন, আরে মূর্খ! আমাকে মেরে তোর কি লাভ হবে ? তোর কাল কোথাও না কোথাও জন্ম নিয়েছে । তুই আর বৃথা শিশু হত্যা করিস না।"

এই বলে দেবী অদৃশ্য হলেন। বৃহত্তর বঙ্গে প্রাচীনকাল থেকেই শাক্ত, শৈব এবং বৈষ্ণবদের মিলনকেন্দ্র ছিল। এ কারণে আজও আমরা দেখি, বঙ্গের কালী মন্দিরে যেমন শ্রীকৃষ্ণ পূজিত; ঠিক একইভাবে শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরে দেবী কালিকা পূজিতা।শ্রীকৃষ্ণ এবং কালী আদিকাল থেকেই একাকার হয়ে বাঙালির দুই প্রধান আরাধ্য দেবতায় পরিণত হয়েছে। তাই যেখানেই বাঙালি সেখানেই দেবী কালী এবং সেখানেই শ্রীকৃষ্ণকানাই। সনাতন ধর্মের বিশ্বাস এবং উপাসনা পদ্ধতি একটি ঐক্যবদ্ধ সমন্বিত প্রচেষ্টা। কোন এককেন্দ্রিক ব্যক্তি সর্বস্ব মতবাদ এখানে অগ্রাহ্য। তাই এই সম্প্রীতি সমন্বয়ের মহাসমুদ্রে কেউ যদি এককেন্দ্রিক চশমা পরে সকল কিছুই দেখতে চায় ; তবে সে প্রচণ্ড ভুল করবে। সনাতন উপাসনা পদ্ধতি সকল মত-পথ নির্বিশেষে এক পরমেশ্বরকেই সকলে উপাসনা করে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments