অনাদিকাল থেকেই, বৈদিক সাম্যবাদ বহমান

 

ধর্ম ঈশ্বরের প্রবর্তিত সর্বাঙ্গসুন্দর একটি শাশ্বত সত্ত্বা। সমাজ ঠিক উল্টা, মানুষ তার ইচ্ছামত, সুবিধামত বিনির্মাণ করে। স্বার্থান্বেষী মানুষের কারণে বিভিন্ন সময়ে অনেক অসঙ্গতি যুক্ত হয়, যা ধর্মের নাম প্রচলিত হলেও ধর্মের সাথে যুক্ত নয়। এ বিভিন্ন অসঙ্গতি ঘনীভূত হয়েই নানাপ্রকার সামাজিক অসন্তোষ দানা বাঁধে। মানুষের মাঝে ঐক্যহীনতা দেখা দেয়। অথচ সৃষ্টির শুরুতেই ঋগ্বেদ সংহিতার সংজ্ঞানসূক্তে যে জগতের প্রচলিত জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানবের যে ঐক্যবদ্ধতার প্রেরণা দেয়া হয়েছে; তা মানব ইতিহাসে এক বিরল অনুপম দৃষ্টান্ত। সেই সূক্তে 'সমান' শব্দটি বারবার অনুপ্রাস অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছেন। সেই সূক্তে একই সাথে চলা,বলা ঈশ্বরের উপাসনা, খাদ্যপানীয় সহ সকল ক্ষেত্রেই সমান হতে বলা হয়েছে। জগতে এর থেকে বড় সাম্যবাদের কি হতে পারে? কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (৫ই মে, ১৮১৮ –১৪ই মার্চ, ১৮৮৩) সহ জগতের অন্যান্য সাম্যবাদীরা এর বাইরে কোন নতুন কথা বলেননি।

সাম্যবাদ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল communism. শ্রেণীহীন, শোষণহীন, ব্যক্তি মালিকানাহীন এমন একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাবাদর্শ যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানার স্থলে উৎপাদনের সকল মাধ্যম এবং প্রাকৃতিক সম্পদ (ভূমি, খনি, কারখানা) রাষ্ট্রের মালিকানাধীন এবং নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। সাম্যবাদ হল সমাজতন্ত্রের একটি উন্নত এবং অগ্রসর রূপ, তবে এদের মধ্যেকার পার্থক্য নিয়ে বহুকাল ধরে বিতর্ক চলে আসছে।উভয়েরই মূল লক্ষ্য হল ব্যক্তিমালিকানা এবং শ্রমিক শ্রেণীর উপর শোষণের হাতিয়ার পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থার অবসান ঘটানো।কার্ল মার্কস যে মতাদর্শ উপস্থাপন করেছিলেন সেই মতে সাম্যবাদ হল সমাজের সেই চূড়ান্ত শিখর, যেখানে পৌঁছাতে হলে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজে অর্থনৈতিক সাম্য স্থাপন করতে হবে। সেই ক্রান্তিকালে উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে, সমাজে সামগ্রী ও সেবার অতিপ্রাচুর্য সৃষ্টি হবে। সাম্যবাদী দর্শনানুসারে, কোনো দেশে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠিত থাকলে সে স্থানে ধনী-গরীবের ব্যবধান থাকবে না। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার দ্বায়িত্ব গ্রহণ করবে সাম্যবাদী সরকার।সাম্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হল অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাম্যতা। কিন্তু সুপ্রাচীন বৈদিক সাম্যবাদ আরও গভীর, আরও সুস্পষ্ট এবং আরও বহুক্ষেত্রে প্রসারিত।

সং গচ্ছধ্বং সং বধ্বং সং বাে মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে॥
সমানাে মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বাে হবিষা জুহােমি॥
সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমন্ত বাে মনাে যথা বঃ সুসহাসতি॥
(ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২-৪)

"হে মানব, তােমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে একই ঐক্যের কথা বলো, তােমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হােক। পূর্বকালীন জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেমন করে কর্তব্য কর্ম এবং উপাসনা করেছে, তােমরাও তেমন করে আমার পথে চল।

তােমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হােক,
মিলনভূমি এক হােক এবং মনসহ চিত্ত এক হােক। তােমরা একতার মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে অগ্রগামী হও। তােমাদেরকে দেয়া খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করে গ্রহণ কর।

তােমাদের সকলের লক্ষ্য এক হােক, হৃদয় এক হােক এবং মন এক হােক। তােমরা সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও।"

"সং গচ্ছধ্বং": বর্তমানে আমরা দিনেদিনে অসহিষ্ণু হয়ে যাচ্ছি, স্বার্থান্ধ হয়ে যাচ্ছি। সকলেই নিজ নিজ মত-পথের ভিন্নতা নিয়েই আপন পরিমণ্ডলে পরিভ্রমণ করছি। কিন্তু বৈদিক সাম্যবাদ ব্যক্তিগত সংকীর্ণতা পরিত্যাগ করে একসঙ্গে চলতে বলেছেন। বৈশ্বিকভাবে সকল জাতিগোষ্ঠী যেন সকলেই সকলের একটু কাছাকাছি আসতে পারে এই শাশ্বত প্রেরণা দেয়া হয়েছে। বৈদিক মন্ত্রে উক্ত "সং গচ্ছধ্বং" ভাবটি গত শতাব্দীতে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠায় লক্ষ্য করা যায়। নিজ নিজ কূপে থেকে কূপমণ্ডূক না হয়ে আমাদের উচিত যথাসম্ভব সমানতার ভাবকে মাথায় নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে চলা।

"পৃথিবীর বুকে আমরাই
প্রথম এনেছি বৈদিক সাম্যবাদ।
যেথা ঋষিকন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল-
'সং গচ্ছধ্বং সংবদধ্বং সংবো মনাংসি জানতাম।'

সাম্যবাদের আদর্শের চেতনায়
হতে চেয়েছি দেবতা;
দুষ্ট অসুরের দল তাকেই
মনে করেছে ক্লীবতা।"

"সং বধ্বং"; জগতের সকল জাতিই বৈশ্বিকভাবে একই কথা বলবে না।এ কথা যেমন সত্য, ঠিক তেমনি অবিসংবাদিত সত্য হল, মৌলিক অধিকার, প্রকৃতি পরিবেশ রক্ষা সহ বেশ কিছু ক্ষেত্রে জগতের সকল মানবকেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে একই সাম্যবাদী কথা বলা প্রয়োজন। মানুষের বিশ্বাস, চিন্তা এবং বাক্যে ভিন্নতা থাকবে।কিন্তু সেই ভিন্নতা মনুষ্যত্ব বোধকে কখনোই ভূলন্ঠিত করতে পারবে না।

"দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে": আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কর্তব্য কর্ম এবং ঐশ্বরিক উপাসনা করতে হবে। এ উপাসনায় কোন বিভেদ কাম্য নয়।এক অদ্বিতীয়, পরমেশ্বরই এ বিশ্বসংসার এবং সনাতন ধর্মের প্রবর্তক। তিনি সৎ, চিৎ (চিন্ময়) এবং আনন্দময়স্বরূপ। তিনি চিন্তার অতীত, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, সর্বজ্ঞ, অভয়, কৃপাময় এবং সৃষ্টি, পালন ও লয়কর্তা। জীবের চিন্তার অতীত এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন গুণ ও শক্তির প্রতীকী প্রকাশ হলেন দেবতাগণ। ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। এ পঞ্চমতের সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধা পোষণ করে সকল মতকেই সত্য বলে জেনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঈশ্বরের উপাসনা কিরতে হবে।

"সমানাে মন্ত্রঃ": এ বাক্যে ঈশ্বর নির্দেশ দিয়েছেন আমাদের সকলের মন্ত্র যেন এক হয়। বেদ,রামায়ণ মহাভারত সহ যে মন্ত্রটি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত, তা হল ওঙ্কার(ॐ)। এ পবিত্র ওঙ্কার মন্ত্রই গায়ত্রী মন্ত্রের সাথে সংযুক্ত করে গায়ত্রীসন্ধ্যায় নিত্য জপ করতে হয় । আমরা যে যে মত-পথের সম্প্রদায়ভূক্ত হই না কেন, আমাদের সকলেরই বৈদিক ওঙ্কার এবং গায়ত্রী মন্ত্রের শরণে আসা উচিত। তবেই আমরা ঋগ্বেদের 'সংজ্ঞানসূক্তে' ঈশ্বর নির্দেশিত সমান মন্ত্রভূক্ত হতে পারব। বিভিন্ন মত-পথের সম্প্রদায়গত মন্ত্রকে দ্বিতীয় পর্যায়ে রেখে, আমাদের সকলের উচিত ত্রিসন্ধ্যা গায়ত্রী মন্ত্রের জপ করা।

"সমিতিঃ": ভাবতে প্রচণ্ড আবাক হতে হয় যে, সংগঠনবাচক 'সমিতি' শব্দটি বেদেই উক্ত হয়েছে। আজ সমিতি শব্দটি সর্বক্ষেত্রে ব্যবহৃত হলেও, আমরা অধিকাংশ মানুষই এ শব্দটির উৎস যে বেদ, এ তথ্যটি জানি না। সত্যযুগে প্রয়োজনীয় না হলেও বর্তমান কলিযুগে ঐক্যবদ্ধতার জন্যে সমিতিবদ্ধতার প্রয়োজন অনস্বীকার্য।

"সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্": জগতের সকলের মন সহ চিত্ত এক হওয়া প্রয়োজন। তবেই আমরা একে অন্যের দুঃখ বেদনা উপলব্ধি করতে পারব। আমরা সমদর্শী হতে পারব। সমদর্শী হতে পারলে জগতের সকলের মাঝেই নিজেকে এবং নিজের মাঝেই সকলকে দেখতে পাব।

"সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ":একতার মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে আমাদের অভি বা অগ্রগামী হতে হবে। আমরা জগতের পরিবেশ প্রকৃতি এবং মানবের মাঝে সমদর্শী না হলে, সর্বভূতে যে এক পরমেশ্বরই বিরাজ করছেন -সেই উপলব্ধি কখনোই আমাদের মাঝে আসবে না। বেদ আমাদের শিক্ষা দিচ্ছে, আমাদের এক হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু বর্তমানে আমরা নিজেদের তৈরি শতসহস্র শৃঙ্খল পায়ে পড়ে নিজেরাই নিজেদের চলার গতিপথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছি। কিছু মানুষ ঈশ্বরের নামে অহেতুক অমানবিক যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করছে। আবার কেউ জাতপাতের নামে মনুষ্যত্বকে ভূলন্ঠিত করছি। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমাদের উচিত সকল বিভেদের জালকে ছিন্ন করে ঐক্যবদ্ধ হয়ে জগতের কল্যাণ করা। নিজে আগে অগ্রগামী হয়ে শুদ্ধ প্রজ্জ্বলিত প্রদীপ হয়ে; পরবর্তীতে সেই প্রদীপ থেকে অনন্ত প্রদীপকে প্রজ্জ্বলিত করা।

"সমানেন বাে হবিষা জুহােমি": এ জগত ঈশ্বরের। জগতের সকল খাদ্যপানীয়ও ঈশ্বরের। আমাদের প্রত্যেকেই উচিত যথাসম্ভব খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করেই তবে গ্রহণ কর। কেউ শুধুই খেয়ে যাবে, বিপরীতে কেউ খাদ্যের অভাবে উপবাস করবে বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং পরিতাপের। ঈশ্বর অন্নকে ভাগ করে খেতে বলেছেন। এ কারণেই সনাতন ধর্মে পঞ্চমহাযজ্ঞের প্রবর্তন করা হয়েছে। বৈদিক পঞ্চমহাযজ্ঞ মতে প্রত্যেকদিনই মানুষকে অন্নদান করতে হয়। অন্নদান করে খাদ্যগ্রহণ করাকে বলে 'নৃযজ্ঞ'। মানুষের সাথে সাথে প্রত্যেকদিনই প্রাণীকুলকে অন্নদান করতে হয়ে, সেই প্রাণীকুলকে অন্নদানকে বৈদিক পরিভাষায় বলে 'ভূতযজ্ঞ'। শাস্ত্রে কাউকে অন্নদান না করে, খাদ্য গ্রহণ করা হতভাগ্য ব্যক্তিকে চোর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই ক্ষুধার্ত এবং দারিদ্রকে অন্নসহ বিবিধ প্রকারের দানকে প্রশংসিত করে একাধিক মন্ত্র ঋগ্বেদ সহ বেদের বিভিন্ন স্থানে দৃষ্ট হয়।

বৈদিক সাম্যবাদের লক্ষ্য হল, সমন্বিতভাবে জগতের সকলের কল্যাণ; এবং এ সর্বজনীন কল্যাণমূলক কাজে সকলের অংশগ্রহণ। কাউকে ছোট-বড় দৃষ্টিতে বিবেচনা না করে সাম্যবাদী দৃষ্টিতে দেখা। বৈদিক সাম্যবাদের দৃষ্টান্ত আমরা রামায়ণের মধ্যে দেখতে পাই।ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ঈশ্বরের অবতার হয়েও রাবন বধ করে সীতা উদ্ধারের কল্যাণকর কাজে সামান্য বানরসেনাদের ঐক্যবদ্ধ করে তাদের নিযুক্ত করেছিলেন। সামান্য বানরসেনারা ভগবানের নির্দেশনায় সমুদ্রের মাঝে সেতু নির্মাণের কাজে অংশগ্রহণ করে গৌরবান্বিত হয়েছিলেন। তাই নল, সুগ্রীব, হনুমান সহ সকল বানরসেনাদের শ্রদ্ধার সাথে আজও স্মরণ করা হয়। জগতের প্রত্যেকটি মানুষের চিন্তা, ভাব, দর্শন এবং বিশ্বাস আলাদা। জগতের মানুষ আলাদা আলাদা বৈচিত্র্যময় হলেও যদি তাদের সকলের সত্ত্বার মাঝে একটি মানবিক একত্বের বন্ধন থাকে, তবে জগতের অধিকাংশ বৈরীতা হিংসা- বিদ্বেষের ভাব এমনিতেই দূরীভূত হয়ে যাবে। সকলের হৃদয়ের আকুতি মিলিত হলেই মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে। সাম্যবাদী চেতনায় ঐক্যবদ্ধতা ছাড়া কল্যাণকর আর কোন পথ নেই।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments