যোগেশ্বর শ্রীকৃষ্ণের সাথে, ধনুর্ধর পার্থকেও প্রয়োজন

 



শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কথা বলা শুরু করেছেন দ্বিতীয় অধ্যায় সাংখ্যযোগের দ্বিতীয় শ্লোক থেকে, এই শ্লোকে ভগবান অর্জুনকে অনার্য জনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্তিকর মোহ ত্যাগ করতে বলেছেন।


শ্রীভগবানুবাচ 

কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।  

অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন ॥ 

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ০২.০২)


"শ্রীভগবান বললেন, হে অর্জুন এই সঙ্কটকালে অনার্যের মত, স্বর্গগতির প্রতিবন্ধক, অকীর্তিকর মোহ তোমার কেন উপস্থিত হল?"


এর ঠিক পরের তৃতীয় শ্লোকেই ভগবান দৃঢ়কন্ঠে ঘোষণা করেছেন, হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াতে। আমরা যদি যদি হৃদয়ের ভয় এবং জড়তাকে পরিত্যাগ করতে না পারি, তবে ভয় এবং জড়তা আজীবন আমাদের পিছনে ধাওয়া করে গ্রাস করতে থাকবে। যেমন সাপ দেখে আমরা বিচারও করি না যে, সাপটি বিষাক্ত কি বিষাক্ত নয়। সাপের বিষাক্ততা বিচার না করেই রাস্তায় সাপ দেখলে আমরা সাপের ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে আপ্রাণ দৌড়াতে থাকি। আমরা যতই দোড়াতে থাকি সাপ ততই আমাদের পিছনে পিছনে ধাওয়া করতে থাকে। কিন্তু আমরা যদি একবার দাঁড়িয়ে দিয়ে হাতে লাঠি নিতে পারি। তবে সেই লাঠির ভয়ে প্রাণ বাঁচাতে সাপ উল্টো দৌড়ে পালায়। তাই সাপ দেখলে লাঠি নিয়ে যে যে অবস্থানেই আছি, সেই সেই অবস্থান থেকেই দৃঢ় মনোবল নিয়ে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে, তবেই সাপ ছোবল দেয়া ভুলে উল্টো মরণত্রাসে পালাবে। কিন্তু যদি আমরা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারি, তবে আমি চাই বা না চাই আমাকে বিষাক্ত সাপের ভয়ে দিনরাত্রি পালিয়ে বেড়াতেই হবে। মনে রাখতে হবে, সকল বিষয়েরই একটি পরিসমাপ্তি রয়েছে। দিনের পরেও রাত আসে, আবার রাতের অন্ধকারের পরেই দিনের আলো আসে। মানুষ যেমন বিষাক্ত সাপকে ভয় পায়, তেমনি বিষাক্ত সাপও সাহসী মানুষকে প্রচণ্ড ভয় পায়। তাই শ্রীমদভগবদগীতায় দার্শনিক তত্ত্বের শুরুতেই অর্জুনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুর্বলতা এবং ক্লীবতা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে বলেছেন।আমরা যদি দুর্বলতা এবং ক্লীবতা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করতে না পারি, তবে কখনই আমারা ভগবান শ্রীষ্ণের প্রকৃত অনুসারী হতে পারবো না। 


ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয়্যুপপদ্যতে।

ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্য ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ০২.০৩)


"হে অর্জুন হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও; এমন ক্লীবতা কাপুরুষতা তোমার শোভা পায় না।"


মনে রাখতে হবে,"বীরভোগ্যা বসুন্ধরা"। কোন দুর্বল চিত্তের, ক্লীব স্বভাবের ব্যক্তি নয়; শুধু অকুতোভয় বীর স্বভাবের ব্যক্তিরাই এ বৈচিত্র্যময় বসুন্ধরাকে যথাযথ ভোগ করতে পারে। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকেন, জগত তাদের মুঠোয় থাকে। মৃত্যুর পরেও তাঁদের বীরত্বের কীর্তি যুগযুগান্তর ধরে অবিনশ্বর থাকে। শ্রীমদ্ভগবদগীতা হতে যথাযথ জ্ঞান লাভ করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জ্জুনকে দৃঢ়চিত্তে যুদ্ধে অগ্রসর হয়ে অধর্মকে বিনাশ করতে বললেন। তিনি স্মরণ করিয়ে দিলেন, এই ধর্মযুদ্ধে যদি মৃত্যু হয়, তবে অক্ষয় স্বর্গ লাভ হবে এবং যুদ্ধে জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করতে পারবে। ভগবান যখন অবতাররূপে আসেন, তখন ধর্ম রক্ষা করতে তিনি নিজেও অস্ত্রধারণ পাপিদের বিনাশ করেন। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় শ্রীকৃষ্ণের মুখে বলা প্রথম শ্লোকগুলি এবং সঞ্জয়ের মুখে বলা গীতার শেষ শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যময়, মাহাত্ম্যপূর্ণ এবং ইঙ্গিতবহ। কথাগুলি বর্তমান হিন্দুজাতির জন্যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। শেষ শ্লোকে বলা হয়েছে যে শুধুমাত্র ধর্ম ধর্ম করলেই হবে না; ধর্মকে রক্ষাকারী সক্রিয় ধনুর্ধারী পার্থ অপরিহার্য। যদি আমরা ধর্মকে যথাযথ রক্ষা করি, তবে শাশ্বত ধর্মই সকলদিক থেকে আমাদের রক্ষা করবে। তাই আমাদের সর্বদা ধর্মের আশ্রয়েই থেকে ধর্মকে রক্ষা করা প্রয়োজন। 


যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্ধরঃ।

তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভূতিধ্রুর্বা নীতির্মতির্মম।।

(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৮.৭৮)


"যেখানেই যোগেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধনুর্ধারী রক্ষাকারী পার্থ থাকবে; সেখানেই সর্বদা শ্রী, বিজয়, উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি এবং ঐক্যবদ্ধতার অখণ্ডিত রাজনৈতিক নীতি সর্বদাই বিরাজ করবে।"


ধর্মাধর্মের সকল নির্দেশনা হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে দেয়া আছে। পাষণ্ড, দুর্জন, পৈশাচিক ভাবাপন্নদের সমূলে বিনাশ করতে বলা হয়েছে। তারা জগতের জন্যে অকল্যাণকর, বিশ্বসভ্যতার জন্যে অকল্যাণকর। বর্তমানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার অনুসারীদের চেনা যায় না। তাদের অধিকাংশের একটা আত্মকেন্দ্রিক ক্লীব ভাব দেখা যায়। তারা সুধুই নিজদের সাধন, ভজন এবং ধর্মীয় আচরণ নিয়েই ব্যতিব্যস্ত। দেশ, জাতি এবং ধর্ম রক্ষার্থে তাদের খুব একটি মাথাব্যথা নেই। বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। তবে বিষয়টির ব্যতিক্রমও আছে। তুর্কি, পাঠান, ব্রিটিশ সহ বিভিন্ন বিদেশি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অনেক স্বদেশীয় ক্রান্তিকারীরা দেশ-জাতির ক্রান্তিলগ্নে গীতায় বর্ণিত অবিনাশী আত্মার তত্ত্বে বিশ্বাস স্থাপন করে নির্ভীক চিত্তে আমৃত্যু সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন। 


সারা পৃথিবীতে বিস্তৃত ব্রিটিশের সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত হত না, সেই ব্রিটিশ শুধু ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনের মত বিপ্লবীদের কাছে অসহায় হয়ে যায় ; শুধু তাঁদের মনবলের কারণে। মানুষের শক্তি তার দেহে যতটা দৃশ্যমান ; অদৃশ্য হয়ে মনজগতে ততটাই বিস্তৃত। শুধু সাহস নিয়ে দাড়িয়ে গেলেই হয়। বিপ্লবীরা যখন উপলব্ধি করেছে, আত্মা অবিনাশী, দেহের মৃত্যুতেও আত্মার বিনাশ হয় না; তখন তাঁরা সামনে যতবড়ই ভয়ংকর সাম্রাজ্যবাদী হানাদার হোক, সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছে। এর পরিণামেই সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশেরা এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ঘরে বসে চরকায় সুতা কেটে ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়নি, হয়েছে ক্ষুদিরামদের মত অসংখ্য বিপ্লবীদের আত্মত্যাগে। শ্রীমদ্ভগবদগীতাই তাঁদের শিখিয়েছে, প্রত্যেকটি মানুষের অন্তঃস্থিত আত্মাকে শস্ত্রের দ্বারা ছেদন করা যায় না, অগ্নিতে দগ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না এবং বায়ু তাকে শুষ্ক করতে পারে না। আত্মাকে যেহেতু কোনভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করা যায় না, তবে কিসের মৃত্যুভয়?হিন্দু আজন্মকাল থেকেই শক্তির উপাসক। তাদের উপাস্য সশস্ত্র দেবদেবীরাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাই ধনুর্ধারী পার্থ বা শক্তির উপাসনাতেই সে পুনরায় আবার জাগবে।প্রদীপের টিমটিমে সলতের মত যারা বাঁচতে চায়, তারা বাঁচতে পারে না; পক্ষান্তরে যারা বাঁচা-মরাকে তোয়াক্কা করেনা, তারাই অমর হয়ে বেঁচে থাকে। তাই ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের শিখিয়েছেন :


"সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।

 সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ।

মুক্ত করো ভয়,  আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, 

নিজেরে করো জয়।"


সম্মুখে সঙ্কটের কল্পনাতে বিহ্বল না হয়ে নিজের  অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। কেউ অধিকার ভিক্ষা দিবে না। আবার ভিক্ষায় পাওয়া অধিকারে গৌরবও থাকে না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদগীতায় এ শিক্ষাটিই দিয়েছেন যে নিষ্ঠার মাধ্যমে যারা যার দায়িত্ব কর্তব্য নিষ্কামভাবে পালন করে যাওয়া। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অসংখ্য প্রচেষ্টা করেও আপস বা শান্তির দ্বারা তাঁর হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করতে পারলেন না। বিনিময়ে পেলেন নিজবংশের দুর্জনের সীমাহীন অত্যাচার এবং বঞ্চনা। সকল শান্তির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায়  যুধিষ্ঠিরকে ভয়াবহ যুদ্ধ করে হলেও নিজভূমি পুনরুদ্ধার করতে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্মর্তব্য  চট্টগ্রাম শংকর মঠের সন্ন্যাসী শ্রীমৎ স্বামী নলিনানন্দের একটি সংগীত। সংগীতটি 'গীতা গীতিমালা' নামক শ্রীমদ্ভগবদগীতার ভাববস্তুর উপরে আধারিত একটি সংগীতের গ্রন্থের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। সে সংগীতে তিনি পার্থ এবং পার্থসারথিকে আহ্বান করে বলেন: 


"এস পার্থ সারথি, বল গীতা পদ্ধতি,

সুমধুর পাঞ্চজন্য সুরে।

আগে পার্থে বলেছিলে, কুরুক্ষেত্র রণস্থলে,

আজি আবার বল তাহা দয়া করে।

ধর্ম যুদ্ধ করিবারে, ভক্তি অস্ত্র দাও করে,

আত্মরাজ্য স্থাপন করি দেহঘরে।

পালিতে সংসার ধর্ম, বুঝিবারে গীতার মর্ম,

সুপ্তধর্ম জাগায়ে দাও হৃদি মাঝারে।

 বিশ্বে তোমার পূজা করে, শ্রদ্ধা ভক্তি সহকারে,

তবু মনে হয় পূজা হল নারে।"

(গীতা গীতিমালা:৫)


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments