সংখ্যালঘুদের নামের উপরে, শিক্ষাবোর্ডের কাঁচি কাম্য নয়

ছোটবেলায় যখন মাদারীপুর ইউ আই সরকারি স্কুলে পড়তাম তখন আমার ক্লাসশিক্ষক আমার কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী নামটি দেখে  আমাকে বলতেন, "তোর নামটি  হাতির মত বড়। এতবড় নাম বলা যায়! একটু ছোট করে নিস নামটি"। অনেক ক্লাসেই ক্লাস শিক্ষকসহ অন্যান্য স্যারেরা এ কথাটি বলতেন। তাদের কথা শুনে আমিও মনেমনে ভাবতাম, সত্যি আমার নামটি অনেক বড়, এটা ছোট করা প্রয়োজন। শিক্ষকের ভাষায় এমনিতেই নাম অনেক বড়, সেই বড় নামের সাথে আর 'শ্রী' শব্দ যুক্ত করে আরও বড় করতে আর সাহস পাইনি। কারণ বড় নামের কথা শিক্ষকের মুখে শুনতে শুনতে আমার ক্লাসের বন্ধুরাও বলা শুরু করে, হাতির মত নাম ইত্যাদি। বন্ধুদের মুখে মুখে ছিল, হাতির মত নাম। যখন এসএসসি পাশ করি তখনই একদিন ক্লাসের সকল বন্ধুদের নামের তালিকায় আমার চোখ পড়ে। সেদিন আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি, আমার ক্লাসে আমার থেকে আরও বড় বড় নাম রয়েছে। অনেকের নামের সাথে পাঁচ থেকে সাতটি  বা এরও অধিক শব্দ রয়েছে। তারা কেই (OMR) শিটে নিজের সম্পূর্ণ নামও লিখতে পারে না। কিন্তু আমি তো অন্ততপক্ষে আমার সম্পূর্ণ নামটি (OMR) শিটে লিখতে পারি। তবে অন্য বন্ধুদের নামের প্রতি কেন ক্লাস শিক্ষকের দৃষ্টি যায় না। অথচ আমার রোল কল করার সময়ে "হাতির মত নাম" বাক্যটি নিয়মিতই শুনতে হোত। আজ যখন সেই বিদ্যালয়ের দিনগুলোর কথা চিন্তা করি, আমি ভেবে পাই না ক্লাস শিক্ষকের আমার নাম নিয়ে আপত্তির কারণ। উত্তর হিসেবে একটি বিষয়ই মাথায় ঘুরপাক খায় তা হল, তাদের সাম্প্রদায়িক মনন। কিন্তু আমি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের সে দৃষ্টিতে দেখতে চাই। কারণ এক অক্ষর হলেও তাদের থেকে বিদ্যা লাভ করেছি। হয়ত তার ক্লাসের ছাত্রদের ছাত্র হিসেবে দেখার শৈলীটির মধ্যে নিরপেক্ষতা ছিল না। তবে আমার কাছে আজও তারা সম্মানিত। কারণ তারা আমার প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার কারিগর। নাম নিয়ে আমার জীবনের এ কাহিনী নব্বইয়ের দশকের কথা। কিন্তু এর মধ্যে দুটিদশক পাড়ি দিয়ে আজ একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যদি দেখি দেশের প্রধান বোর্ড ঢাকাসহ অন্যান্য বোর্ডগুলো ছাত্রদের জন্য নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে যে, সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীরা তারা তাদের নামের পূর্বে শ্রী এবং শ্রীমতী শব্দদ্বয় ব্যবহার করতে পারবে না। তখন এর থেকে দুঃখজনক আর কিছুই হতে পারে না। তখন নিজের অজান্তেই মনে প্রশ্ন জাগে জাতিগতভাবে কি আমরা এগিয়ে যাচ্ছি নাকি বানরের মত এক পা এগিয়ে দুইপা পিছিয়ে যাচ্ছি। এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর যেমন আছে, তেমনি আবার নেই।বাংলাদেশের প্রথম এবং প্রধান বোর্ড রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত ঢাকা বোর্ড। অন্যান্য বোর্ডগুলো পরবর্তীকালে হয়েছে। ০৭.০৩.২০২১ মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ঢাকার বিজ্ঞপ্তিতে লেখা রয়েছে:



"৮.(গ) শিক্ষার্থীর নামের পূর্বে Mr. Mrs. Miss, Sree, Sreemoti ইত্যাদি ধরনের শব্দ ব্যবহার করা

যাবে না।"


ঢাকা বোর্ডকে অনুসরণ করে অন্যান্য বোর্ডগুলোও একই পথে হাটছে। ছাত্রের নাম রেজিষ্ট্রেশনের নিয়মাবলিতে কুমিল্লা বোর্ডের ২০.০৩.২০২১ সালের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে:


"ঘ ২. শিক্ষার্থী, পিতা ও মাতার নামের পূর্বে Mr. Mrs, Miss Sree Sreemoti, Advocate, Hazi Al-haz, Engr., Late, Major, colonel, Brigadier,Dr.prof. ইত্যাদি ধরণের পদবি এবং নামের শেষে Ma, MCOM, MSC, BA, BCOM, BSC, BSS.BBS, FRCS, PHD, FCPS, FCA, Master ইত্যাদি ধরণের শিক্ষাগত যোগ্যতা সূচক শব্দ ব্যবহার করা যাবে না।"


বোর্ডের এ সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে বিমাতাসূলভ আচরণ। এক দেশে এভাবে দুই নিয়ম থাকতে পারে না। একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের শিশু তার ধর্মীয় বিশ্বাসবাচক শব্দ ব্যবহার করতে পারবে ; পক্ষান্তরে একই সাথে সেই শিশুটির সহপাঠী তাঁর ধর্মীয় বিশ্বাসবাচক শব্দ 'শ্রী' ব্যবহার করতে পারবে না। বিষয়টি প্রচণ্ড আপত্তিকর এবং হতাশার। অথচ শ্রী শব্দটি কোন ধর্মীয় শব্দ নয়। শব্দটির ব্যবহার সংকীর্ণ করতে করতে এখন শব্দটি হিন্দু সম্প্রদায়ের শব্দে পরিণত হয়েছে। পূর্বে এই ভূখণ্ডে হিন্দু, বৌদ্ধ,  আদিবাসী, মুসলিম নির্বিশেষে সকলেই শ্রীশব্দটি সৌন্দর্য এবং লক্ষ্মীবাচক শব্দ হিসেবে নামের পূর্বে ব্যবহার করত।বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার অংশে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। 


"অনুচ্ছেদ -২৮: (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।"


এই সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারকে সম্পূর্ণভাবে লঙ্ঘন করে দেশের শিক্ষাবোর্ড হিন্দু সম্প্রদায়ের নামের পূর্বে অনন্তকাল থেকে চলে আসা 'শ্রী' এবং 'শ্রীমতী' শব্দদ্বয় ইচ্ছাকৃতভাবে বাদ দিয়ে দিচ্ছে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব সুস্পষ্ট। এভাবে যদি শিক্ষাবোর্ডের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি বজায় থাকে, তবে আগামীতে হয়ত এরা সৌদি আরবের পথও অনুসরণ করতে পারে। বর্তমানে সৌদি আরব ধীরেধীরে উদারচিন্তার দেশের দিকে হাটা কিছুটা শুরু করেছে। সেখানে বর্তমানে রামায়ণ এবং মহাভারত পাঠক্রমের অঙ্গীভূত হয়েছে। সেই সৌদি আরবে রাষ্ট্রীয়ভাবে শিশুদের নামকরণের ক্ষেত্রে একটি নিষিদ্ধ তালিকা রয়েছে। সেই তালিকায় প্রায় পঞ্চাশটি নিষিদ্ধ নামের তালিকা রয়েছে। যে নাম সৌদি আরবের কোন শিশুর রাখা যায় না। কারণ তাদের ভাষায় সে নামগুলো  সামাজ এবং ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক। নিষিদ্ধ এ সকল নামগুলোই প্রায় আরবি শব্দ । এই আরবি ভাষায় নিষিদ্ধ নামের মধ্যে ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের নাম 'Rama' অন্যতম।


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments