জগতে কেউ আমরা অনন্ত পাপি, অথবা অনন্ত পুণ্যবান নই

সুখে দুঃখে, আনন্দবেদনার সাগরে ভেসে চলা মানুষ আমরা।জগতে কেউ আমরা অনন্ত পাপি বা অনন্ত পুণ্যবান নই। সত্ত্ব, রজঃ, তম এ ত্রিগুণ দ্বারা প্রতিনিয়ত আছন্ন হয়ে আছি আমরা। এ ত্রিগুণকে সহসাই কেউ আমরা চাইলেই অতিক্রম করতেই পারি না। একমাত্র ভগবানই ত্রিগুনাতীত। এ তিনটি গুণ তিনটি পিঠাপিঠি বোনের মতো একে অন্যকে জরিয়ে থাকে। এরা ঝগড়া করবে, মারামারি করবে, চুলাচুলি করবে আবার একসাথে মজা করে তেঁতুল খাবে। একজন অন্যজনকে চোখের আড়ালে যেতে দিবে না এবং এ তিনটি পিঠাপিঠি বোন কাউকে ছাড়া কেউ একা থাকতে পারবে না। তেমনিভাবে প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই এ ত্রিগুণ বা ত্রিগুণের সমন্বয় আছে।এ সমন্বয় থেকেই উত্তম, মধ্যম এবং অধমের উৎপত্তি। আমরা অনেক সময়েই অধমদের এড়িয়ে যেতে যাই; এতে তারা আরও বেশি নিন্দনীয় কাজ করে দূরে চলে যায়। উত্তমের সঙ্গ না পাওয়াতে তারা, সংশোধনের সুযোগ পায় না। সঙ্গ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ সঙ্গের মাধ্যমেই মানুষ প্রভাবিত হয়। উত্তম যখন সত্যিকারের দৃঢ়চেতা উত্তম হবে, তবেই সে অধমকে সঙ্গ দিয়ে সংশোধিত করার প্রচেষ্টা করবে। পক্ষান্তরে উত্তম যদি দৃঢ়চেতা সাত্ত্বিক স্বভাবের না হয়, তবে সঙ্গগুণে অধম উত্তমকে টেনে তমসাপূর্ণ জগতে নিয়ে যেতে পারে। উত্তম যিনি তার যদি নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে, তবে তিনি নিশ্চিন্তে চলতে পারেন অধমের সাথে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কণিকা কাব্যগ্রন্থে 'মাঝারির সতর্কতা' নামক দুই পঙক্তির একটি ছোট্ট কবিতায় বলেছেন:

"উত্তম নিশ্চিন্তে চলে অধমের সাথে,
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে।"

 যিনি সাধু-সন্ত তার প্রধান গুণ যেমন সত্ত্বগুণ এবং সত্ত্বগুণ থেকে উদ্ভূত লোককল্যাণকামী চিন্তা। তেমনি তার মধ্যেও রজোগুণ, তামসিক গুণও আছে বা থাকতে পারে।সাধুসন্তের ভোগসর্বস্ব অলস গদিবালসে আরামে থাকার মানসিকতা উৎপন্ন হয় রাজসিক গুণের প্রভাব থেকে। এবং নিজেকে জাহির করা, আত্মপ্রচার, অন্যান্য সাধুসন্তদের প্রতি ঈর্ষা, শিষ্যদের দিয়ে নিজেকে অবতার বলে প্রচার করিয়ে গ্রাফিক ডিজাইনের মাধ্যমে নিজের পদ্মের উপরে বসা বিভিন্ন সংভংচং মার্কা ছবি প্রচার হল তামসিক গুণের লক্ষণ। 

ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে যেমন ব্রহ্ম আছে, তেমনি প্রত্যেকটি জীব পরিশেষে ব্রহ্মময় হয়েই জন্মজন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্তি লাভ করবে। আমাদের সাত্ত্বিক কর্ম এবং কর্মপ্রচেষ্টাই আমাদের মুক্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই সেই অচিন্ত্যপ্রাণেশ লীলাভরে লীলা করেন।যেহেতু ত্রিগুণ দ্বারা আমরা সবাই আচ্ছন্ন তাই আমরা চাই বা না চাই পাপ আমাদের মোহাচ্ছন্নতা তৈরি করে মুগ্ধ করে। আমরা তখন জলের মধ্যে বাস করেও তৃষ্ণাতুর হয়ে যাই। জল তৃষ্ণায় আমাদের বুক ফেটে যায়। অজ্ঞানতা আমাদের বুদ্ধি লোপ করে দেয়। আকাশে হঠাৎ মেঘ করলে যেমন সূর্য ঢাকা পরে যায়, আবার মেঘ সরে গেলে সূর্য জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাবসত অনেক সময় না বুঝেশুনেই ঈশ্বরের বা দৈবশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলি।কিন্তু পরে যখন অনুতাপ নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত বোধ নিয়ে ঈশ্বরের অহেতুকী স্মরণ নেই তখনই ধীরেধীরে আমাদের হৃদয়ের অজ্ঞান নাশ হতে হতে ব্রহ্মজ্ঞানের, ব্রহ্মপ্রেমের উদয় হয়। এ বিষয়ে বেদে একটি অসাধারণ মন্ত্র আছে:

আপাং মধ্যে তস্থিবাংসং তৃষ্ণাবিদব্জরিতারম্।
মুলা সুক্ষত্র মৃলয়।।
যৎকিং চেদং বরুণ দৈব্যে জনঃ
অভিদ্রোহং মনুষ্যাশ্চরামসি।
অচিত্তী যত্তব ধর্মা যুরোপিম
মা নস্তস্মাদেনসো দেব রীরিযঃ।।
( ঋগ্বেদ : ৭. ৮৯. ৪-৫)

" জলমধ্যে বাস করেও তৃষ্ণার্ত আমি। হে সুক্ষত্র বরুণদেব, দয়া কর, দয়া কর ; আমরা সাধারণ মনুষ্য, দেবগণের সম্বন্ধে আমরা যা কিছু বিরুদ্ধাচরণ করেছি অজ্ঞানতাবশত, সে সকল পাপ থেকে আমাদের মুক্ত করে দাও ; হে দেব তোমার বাৎসল্য প্রেম থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই।"

তাই বেদান্ত চর্চা, নিষ্কাম কর্ম, ইন্দ্রিয় সংযম, সত্ত্বগুণের অভ্যাস, নিত্য এবং নৈমিত্তিক উপাসনা, প্রায়শ্চিত্ত বোধ, সর্বদা ব্রহ্মানুভূতি বেদান্তের এ সকল মূখ্যবিষয়ের অভ্যাস এবং অনুশীলন সর্বদা নিরবচ্ছিন্নভাবে করা উচিৎ। তবেই দেহের মধ্যেই অবস্থিত মুক্তির অশ্বত্থবৃক্ষটি ধীরেধীরে বিস্তার লাভ করে অনন্তে যুক্ত হবে। কাউকে জ্ঞানদানের পূর্বে অধিকারী নিরুপণ করে নিতে হয়। অধিকারী বিহীন জ্ঞান ফলবতী হয় না।অধিকারী সম্পর্কে শাস্ত্রে বলা আছে :

অধিকারী তু বিধিবৎ-অধীতবেদবেদাঙ্গত্বেন আপাততঃ অধিগত-অখিল-বেদার্থঃ অস্মিন্ জন্মনি জন্মান্তরে বা কাম্যনিষিদ্ধবর্জনপুরঃসরং নিত্য-নিমিত্তিক-প্রায়শ্চিত্ত
-উপাসনা-অনুষ্ঠানেন নির্গত-নিখিল-কল্মষতয়া নিতান্ত-নির্মল-স্বান্তঃ, সাধনচতুষ্টয়সম্পন্নঃ প্রমাতা।
(বেদান্তসার:৬)

"বেদান্তের অধিকারী তাঁকেই বলা হয়, যিনি এজন্মে বা আগেকার পূর্ববর্তী জন্মে বিধিপূর্বক বেদবেদান্ত পাঠ করে মোটামুটি অর্থ বুঝেছেন, কাম্য-কর্ম ও শাস্ত্র-নিষিদ্ধ কর্ম ত্যাগ করে নিত্য নৈমিত্তিক, প্রায়শ্চিত্ত ও উপাসনা করে সকল পাপ দূর করে অত্যন্ত নির্মল চিত্তের অধিকারী হয়ে চারটি সাধনকে অবলম্বন করেছেন।"

অধিকারীর ব্রহ্ম বা বেদান্তের প্রতি আগ্রহ তখনই জন্মাবে, যখন ভাল করে তিনি বেদ-বেদান্তের মাহাত্ম্য নিজ অন্তরে উপলব্ধি করবেন। প্রথমেই বেদ-বেদান্ত সবকিছু আপনার ভাল করে পড়তে হবে,জানতে হবে।এর পরবর্তীতে নিত্য নৈমিত্তিক যে দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। অধিকারীর মধ্যে অন্যতম হল প্রায়শ্চিত্ত। অর্থাৎ নিজের পাপকর্মকে স্মরণ করে কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া। এই অনুতপ্ত বোধই অনেক বড় বড় চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীকে সাধুসন্তে রূপান্তরিত করেছে। রামায়ণের রত্নাকর দস্যুর কাহিনী আমরা সকলেই জানি। এই রত্নাকর দস্যুই নিজের পাপবোধের উপলব্ধি থেকে মহর্ষি বাল্মীকিকে পরিণত হয়ে রামায়ণ লিখেছিলেন।

সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments