ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি; নারীর যোগ্য সম্মানেই ব্যাধিটি দূর হবে

ধর্ষণ একটি সামাজিক ব্যাধি।এ ব্যাধিটি যতটা দৈহিক, এর থেকে শতভাগ মানসিক। অসুস্থ মানসিক কামপ্রবৃত্তি থেকেই ধর্ষণের উৎপত্তি ঘটে। ধর্ষণকে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ হেতু শাস্ত্রের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণ অপরাধের জন্যে, শাস্তিস্বরূপ অঙ্গছেদ, দেশ থেকে বহিষ্কার সহ মৃত্যদণ্ডেরও বিধান দেয়া আছে। ধর্ষণ বা নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের প্রচেষ্টারূপ  ব্যভিচার উৎপন্ন হলে সেক্ষেত্রে করণীয় প্রসঙ্গে  মনুস্মৃতিতে সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দেয়া আছে।

পরদারাভিমর্ষেষু প্রবৃত্তান্ নৃন্ মহীপতিঃ। উদ্বেজনকরৈর্দণ্ডৈশ্চিহ্নয়িত্বা প্রবাসয়েৎ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৫২)

"যারা পরস্ত্রী নারীদের জোরপূর্বক যৌন মিলনের প্রচেষ্টা করে ব্যভিচারে রত হয়, রাজা তাদের নাক-কান ছেদন করে এমন শাস্তি দিবেন; যা দেখে সকলে ভীত হয়। সে অবস্থায় তাদের দেশ হতে বিতারিত করতে হবে।"

যোঽকামাং দূষয়েৎ কন্যাং স সদ্যো বধমর্হতি।
সকামাং দূষয়ংস্তুল্যো ন বধং প্রাপ্নুয়ান্নরঃ।।
(মনুসংহিতা:৮.৩৬৪)

"যে পাপিষ্ঠ পুরুষ কোন কন্যাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে, তার কন্যাত্ব ভ্রষ্ট করবে; প্রমাণ পাওয়ার সাথেসাথেই রাজা তাকে সে দিনই বধদণ্ড প্রদান করবেন।তবে কন্যাটির যদি সেই কাজে ইচ্ছা এবং সম্মতি থাকে, তাহলে সম্ভোগকারীর শারীরিক দণ্ড হবে না।"

জোরপূর্বক নারীদের সাথে অবৈধ যৌন মিলনকে ব্যভিচার বলা হয়।সৃষ্টির শুরু থেকেই সমাজে এ ব্যভিচার ছিল এবং বর্তমানেও আছে। বিষয়টি যেহেতু মানসিক এবং সামাজিক সমস্যা। তাই আমরা যতই কঠিন শাস্তি দেই না কেন; সমাজ এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি যদি পরিবর্তিত না হয় তবে এর সমস্যার সমাধান কখনও সম্ভব নয়। সমস্যা যেহেতু মানসিক, তাই এর সমাধানও মনে। বাইরে থেকে আইনের আমরা যতই শক্ত ধারা-উপধারা তৈরি করি না কেন; সমাধান আমাদের সকলের ভেতরেই লুকিয়ে আছে। কোন নারী ধর্ষিত হলে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কিছু মৌলবাদীর দল ধর্মের রেফারেন্স দিয়ে ধর্ষিতা নারীকে এবং তার পরিধেয় পোশাককেই দায়ে করে বিভিন্ন বক্তব্য দেয়। তাদের কথার ভাবভঙ্গিতে মনে হয়, ধর্ষিতা নারীটি কেন এই প্রকারের পোশাক পরিধান করলো, সেই প্রকারের পোশাক পরিধান করলো, খোলামেলা পোশাক পরিধান করলো; তাদের যত চিন্তা নারীর পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে।ধর্ষিতা নারীটি যেহেতু মৌলবাদীদের দৃষ্টিতে অশ্লীল পোশাক পরেছে, তাই সে ধর্ষিত হতেই পারে; এমই তাদের কথার ভাব। অশ্লীলতা এবং পোশাকের দোহাই দিয়ে তারা অনেক সময়ে ধর্ষণকেই জাস্টিফাই করতে চেষ্টা করে। নারী কেন তার আপন খুশীমত খোলামেলা পোশাক পরলো, কেন একাকী রাস্তায় গেল, কেন পরপুরুষের সাথে ঘোরাঘুরি করছে ; ধর্মের নামে ইত্যাদি হাজারটা অভিযোগের ডালা সাজিয়ে মৌলবাদীরা নারীদের দৈহিকভাবে না হলে মানসিকভাবে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করছে।আমাদের সমাজ তাদের বুঝে হোক অথবা না বুঝে প্রতিনিয়ত উৎসাহিত করছে। 

নীতি-নৈতিকতার লেকচার যারা বেশি দেয়, আমার জীবনে দেখেছি; তারাই গোপনে সবচেয়ে বেশি অবৈধ অসামাজিক কাজের সাথে যুক্ত। জগতে ভাল মন্দ অনেকটাই আপেক্ষিক।ভাল-মন্দের সম্পূর্ণ সংজ্ঞা নির্ধারণ করা অনেকটাই অসম্ভব। নারীপুরুষ একজন অন্যজনের কাছাকাছি আসলে সম্পর্কে জড়াবেই। সে নৈতিক হোক অথবা অনৈতিক। একটি তীব্র সম্পর্ক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অন্ধের মত নৈতিক না অনৈতিক এ বিষয়টি পরোয়া করে না। ভালবাসার মানুষের সাথে সম্পর্কটি অনেক সময়েই দৈহিক পর্যায়ে গড়ায়। এতে হয়ত সম্পর্কটি তীব্র হয়, কিন্তু গোল বাঁধে বিভিন্ন মানসিক অবস্থানে। নারীপুরুষ দুজনের সম্মতিতে যে কোন সম্পর্ক হতে পারে। তবে জোর করে, ফাঁদে ফেলে অন্যজনের অসম্মতিতে যখন কিছু হয়; তখনই শাস্তিযোগ্য অপরাধের কারণ হয়।

দুঃখজনক হলেও সত্য অনেকেই এমনটি মনে করে যে, নারীকে ছালার মত কয়েক প্রস্ত ভারি পোশাক পরিধান করিয়ে সর্বদা ঢেকে রাখতে হবে, তবেই সমাজে আর ধর্ষণ সংগঠিত হবে না। যতই প্রগতিশীলতার ভান ধরে থাকুক না কেন, আজও আমাদের সমাজের বহু তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যেও এমন পশ্চাদপদ মানসিকতা দেখা যায়। দুঃখ হয় তখন যখন দেখি, সমাজের উচ্চপদে আসীন অনেক শিক্ষিত নারীরাও এমন মানসিকতা পোষণ করে। তখন মনে হয়, জ্ঞানত অথবা অজ্ঞানত সমাজে নারীরাই কিছুকিছু ক্ষেত্রে নারীমুক্তির অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। একটি পরিবারে নারী শাশুড়ী দ্বারা নির্যাতিত হয়, পুত্রবধূ দ্বারা নির্যাতিত হয় ; শাশুড়ী পুত্রবধূ এরা সকলেই নারী। নারীদের ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা আপাদমস্তক ঢেকে রাখতে চায়, তারা বোকার স্বর্গে বসবাস করে।

 স্বচ্ছ, শুভ্র দুধের বাটি দেখলে হুলো বিড়াল বাটির দুধ খাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে যায়। একদৃষ্টিতে দুধের বাটির চারদিকে ঘোরাঘুরি করে। হুলো বিড়ালের দৃষ্টি থেকে দুধের বাটি সরাতে আমরা দুধের বাটিকেই সর্বদা ঢেকে রাখি।কিন্তু চাইলে আমরা, হুলো বিড়ালকে শাসন করতে পারি। যদি শাসনেও সে সংযত না হয়, তবে বিড়ালটিকে শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখতে পারি। শাস্তি দিতে পারি। হুলো বিড়ালের উপরে কোন পদক্ষেপ না নিয়ে আমরা শুধু দুধের বাটিটিকে কেমন করে, কি দিয়ে, কি কি পদ্ধতিতে ঢেকে রাখব তা নিয়েই ব্যস্ত। অদ্ভুত আমাদের সমাজ এবং আমাদের সমাজপতিরা। ন্যায্য কথায় তাদের অনুভূতির দণ্ড কেঁপে ওঠে।ধর্ষণ একটি মানসিক ব্যাধি;নারীর যোগ্য সম্মানেই ব্যাধিটি দূর হবে। তাই স্মৃতিশাস্ত্রে বিশেষ করে মনুসংহিতায় নারীকে পূজ্যা, সমাদরনীয়া, ভূষনীয়া, সম্মাণীয়া ও বংশের শ্রীবৃদ্ধির কারণ বলা হয়েছে।

পিতৃভির্ভ্রাতৃভিশ্চৈতাঃ পতিভির্দেবরৈস্তথা। 
পূজ্যা ভূষয়িতব্যাশ্চ বহুকল্যাণমীপ্সুভিঃ।।
যত্র নার্যস্তু পূজ্যন্তে রমন্তে তত্র দেবতাঃ। 
যত্রৈতাস্তু ন পূজ্যন্তে সর্বাস্তত্রাফলাঃ ক্রিয়াঃ।।
শোচন্তি জাময়ো যত্র বিনশ্যন্ত্যাশু তৎ কুলম্। 
ন শোচন্তি তু যত্রৈতা বর্দ্ধতে তদ্ধি সর্বদা।। 
জাময়ো যানি গেহানি শপন্ত্যপ্রতিপূজিতাঃ।।
তানি কৃত্যাহতানীব বিনশ্যন্তি সমন্ততঃ।।
তস্মাদেতাঃ সদা পূজ্যা ভূষণাচ্ছাদনাশনৈঃ।
ভূতিকামৈর্নরৈর্নিত্যং সত্কারেষূৎসবেষু চ।।
(মনুসংহিতা:৩.৫৫-৫৯)

"বিবাহসময়ে পতিই কেবল কন্যাকে ধনাদি দিবেন এমন নয়, বিবাহোত্তর কালেও পিতা, ভ্রাতা, পতি, দেবর ইহারা সকলেই যদি বহুকল্যাণরাশির অভিলাষী হয়, তবে ঐ কন্যাদিগকে ভোজনাদির দ্বারা পূজা করবে ও বস্ত্র অলঙ্কারাদির দ্বারা ভূষিত করবে।
যে বংশে নারীরা বস্ত্রালঙ্করাদি দ্বারা পূজা বা সমাদর প্রাপ্ত হন, সেখানে দেবগণ প্রসন্ন হয়ে থাকেন এবং দেবাদি প্রসন্ন হলে পরিবারের সবাই অভীষ্ট ফল প্রাপ্ত হয়। অন্যথা যে বংশে নারীরা সমাদরনীয় নয়, সে গৃহে যাগ,হোম, দেব আরাধনাদি সমস্ত ক্রিয়াই নিষ্ফল হয়ে যায়।

যে বংশে ভগিনী ও গৃহস্থের সপিণ্ড স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূ প্রভৃতি নারীরা ভূষণ-আচ্ছাদন-অন্নাদির অভাবে দুঃখিনী হয়, সেই বংশ অতিশীঘ্র ধ্বংস প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ দৈব ও রাজাদের দ্বারা পীড়িত হয়।পক্ষান্তরে যে বংশে নারীরা ভোজন-আচ্ছাদনাদিতে দুঃখী না থেকে সন্তুষ্ট থাকে সেই বংশের নিশ্চিতভাবে শ্রীবৃদ্ধি হয়। 

ভগিনী, পত্নী, পুত্রবধু প্রভৃতি স্ত্রীরা অনাদৃত হয়ে যে বংশকে উদ্দেশ্য করে অভিশাপ দেন, সেই বংশ অভিচার হতের মত ধনপশু প্রভৃতির সহিত সর্বতোভাবে বিনাশ প্রাপ্ত হয়। 

অতএব যারা ভূতি অর্থাৎ ঐশ্বর্য্য সম্পদাদি কামনা করেন, এইরকম পতিসম্বন্ধীয় লোকেরা উপনয়ন, অন্নপ্রাশন প্রভৃতি বিভিন্ন সৎকার্য্যানুষ্ঠানে এবং নানা উৎসবে অলঙ্কার, বস্ত্র ও ভোজনাদির দ্বারা নিত্য নারীদের পূজা করবে; অর্থাৎ সম্মানিত করবে।"

জগতে যে জাতি বড় হয়েছে, সে নারীকে সম্মানিত করেই বড় হয়েছে।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 
সহকারী অধ্যাপক, 
সংস্কৃত বিভাগ, 
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments