"ধর্মং তু সাক্ষাদ্ভগবৎ প্রণীতং"; সকল ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে ধর্ম

 

পৃথিবীব্যাপী ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদগুলো সুগভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, যিনি মতবাদটি প্রবর্তন করেছেন তার একটি ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার ছাপ রয়ে যায় মতবাদে। প্রবর্তক ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক এবং দৈহিক যৌনস্বার্থে অনেক নির্দেশনা প্রদান করেন অনুসারিদের প্রতি। তার যা ভাল মনে হয় বা খারাপ লাগে তা সকলই জোরজবরদস্তি চাপিয়ে দেন অনুসারীদের প্রতি ধর্মের নামে। বেচারা অনুসারীরাও ইহকাল এবং পরকালের পুণ্যের আশায় অনুসরণ করতে থাকেন। এভাবে কর্তার ইচ্ছায় কর্মের মত গড্ডালিকা প্রবাহে পিছুপিছু নিজেদের ব্যক্তি চিন্তা, মূল্যবোধ এবং স্বতন্ত্রতা পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেন । একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হবে। দার্শনিক মতবাদের প্রবর্তক ব্যক্তি রাত্রির অন্ধকারে পথচলতে অসতর্কতায় হঠাৎ কাঁটাযুক্ত কোন লতাগাছে লেগে গায়ের কাপড় ছিঁড়ে যায়। এই হয়ে গেল! প্রবর্তক ব্যক্তিটি তখন কোন প্রকারের বাদবিচার না করে ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে কাঁটাযুক্ত লতাগাছের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে অনুরারীদের লতাগাছগুলো ধ্বংস করতে নির্দেশনা দিয়ে ফেলবেন। অনুসারীদের বলবেন, "হে আমার সত্যিকারের অনুসারীরা, কাঁটাগাছ যেখানে পাবে সেখানেই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিবে"। ব্যাস হয়ে গেল কাজ। অনুসারীরা প্রবর্তকের নির্দেশ মত, তার ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে পৃথিবীব্যাপি কাঁটাযুক্ত লতাগাছ নিধন শুরু করে দিবে। যেখানে কাঁটা লতাগাছ নেই, সেখানের মানুষেরাও কাঁটা লতাগাছ অন্যদেশ থেকে আমদানি করে আগুনে পুরিয়ে প্রবর্তকের কথা অনুসরণ করবে। তার নিজের পছন্দ-অপছন্দের অভিঘাতে এবং অনুসারীদের যুক্তিহীন অন্ধঅনুসরণে ধীরেধীরে হয়ত জগত থেকে কাঁটা লতাগাছই একদিন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। অথচ প্রকৃতিতে প্রত্যেকটি মানব এবং পশুপাখি যেমন প্রয়োজনীয় ; তেমনি প্রত্যেকটি বৃক্ষ, প্রত্যেকটি গুল্মলতা প্রয়োজনীয়। প্রত্যেকটি বৃক্ষ, গুল্মলতার মধ্যেই আয়ুর্বেদিক ওষুধ রয়েছে। এ কারণে প্রকৃতির প্রত্যেকটি উপাদানকে রক্ষা করা অত্যন্ত আবশ্যকীয়।
ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদের এ গল্পটি কাল্পনিক হয়েও, আমরা এ জাতীয় একপেশে আত্মকেন্দ্রিক ইচ্ছা অনিচ্ছা অনুসারীদের উপরে চাপিয়ে দেয়ার ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে দিকে একটু ভালো করে তাকালে দৃষ্টান্ত বিরল নয়।ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে প্রবর্তক ব্যক্তি, অনুসারীদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করে। তবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী মতবাদের বিপরীতে শাস্ত্রে পাওয়া যায়, ধর্ম একটি শাশ্বত সত্ত্বা। স্বয়ং ঈশ্বর ধর্ম নামক এ শাশ্বত সত্ত্বাটিকে প্রবর্তন করেছেন; কোন ব্যক্তি নয়।ধর্ম সমগ্র জগতের আশ্রয় এবং ধর্মানুষ্ঠানে জীব সমগ্র পাপ মুক্ত হতে মুক্ত হয়। ধর্মই মোক্ষ লাভের একমাত্র উপায়। বেদে বলা হয়েছে :
ধর্মো বিশ্বস্য জগতঃ প্রতিষ্ঠা লোকে ধর্মিষ্ঠং প্রজা উপসর্পত্তি ধর্মের্ণ পাপমপনুদতি ধর্মে সর্বং প্রতিষ্ঠিতং তস্মাদ্ধর্মং পরমং বদন্তি ৷৷
(তৈত্তিরীয় আরণ্যক:১০.৭৯.৭)
" ধর্ম সমগ্র জগতের আশ্রয়। প্রজাগণ ধর্মাধর্ম নির্ণয়ে ধর্মজ্ঞের নিকট গমন করে। ধর্মানুষ্ঠানে সকল পাপ মুক্ত হয়ে সর্বার্থসিদ্ধি হয়। অতএব মহর্ষিগণ বলেন, ধর্মই মোক্ষ লাভের প্রকৃষ্ট উপায়।"
শ্রীমদ্ভাগবতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ধর্ম স্বয়ং সাক্ষাৎ ভগবান কর্তৃক প্রবর্তিত হওয়ায়, এ বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অধীশ্বর ভগবান ছাড়া কেউ ধর্মকে সম্যকভাবে জানতে পারে না। সাধারণ মানুষ বা অসুরদের কথা তো দূরে থাক, মুনি,ঋষি, সিদ্ধগণ এই ধর্মকে সম্যকরূপে জানতে পারেন না। বিভিন্ন মুনি-ঋষিদের তপস্যার গভীরে অথবা ভগবান যখন অবতাররূপে আসেন তখন তিনি জগতের কল্যাণে জীবের প্রয়োজন অনুসারে কিছুটা জানিয়ে দেন। ভগবানের সৃষ্ট শুদ্ধ ও গুহ্য শাশ্বত ধর্মের কথা সকলেই জানতে পারেন না। যিনি কিছুটা জানতে পারেন, তিনিই মুক্ত হয়ে ভগবানের সাথে যুক্ত হয়ে যান। ব্রহ্মা, দেবর্ষি নারদ, শম্ভু, সনৎকুমার, কপিলদেব, স্বায়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ, জনক, ভীষ্মপিতামহ, বলিরাজ, শুকদেব এবং ধর্মরাজ যম এ জগতে দ্বাদশ মহাজনেরাই নিগূঢ়তম ধর্মরহস্য জানেন। ধর্ম একটি অনন্ত শাশ্বত স্বত্ত্বা, এ সত্ত্বাকে সীমাবদ্ধ করা দুষ্কর।
ধর্মং তু সাক্ষাদ্ভগবৎ প্রণীতং
ন বৈ বিদুঃ ঋষয়ো নাপি দেবাঃ।
ন সিদ্ধমুখ্যা অসুরা মনুষ্যাঃ
কুতশ্চ বিদ্যাধরচারণাদয়ঃ।।
স্বয়ম্ভুর্নারদঃ শম্ভূঃ কুমারঃ কপিলাে মনুঃ।
প্রহ্লাদো জনকো ভীষ্মাে বলির্বৈয়াসকির্বয়ম্।।
দ্বাদশৈতে বিজানীমাে ধর্মং ভাগবতং ভটাঃ।
গুহ্যং বিশুদ্ধং দুর্বোধং যং জ্ঞাত্বামৃতমশ্নুতে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত:০৬.০৩.১৯-২১)
"ধর্ম স্বয়ং সাক্ষাৎ ভগবান কর্তৃক প্রবর্তিত। তাই ভগবান ছাড়া ধর্মের স্বরূপ ঋষি, দেবতা বা সিদ্ধগণ কেউ সম্যকরূপে জানেন না। অতএব মানুষ, বিদ্যাধর, চারণ বা অসুরদের তো জানার প্রশ্নই উঠে না।
ভগবানের দ্বারা রচিত ভাগবতধর্ম পরম শুদ্ধ ও গুহ্য, তা জানা অতীব কঠিন , যে সেই ধর্ম জানতে পারে সে ভগবৎসারূপ্য লাভ করে। হে দূতগণ! ভাগবত- ধর্মরহস্য ব্রহ্মা, দেবর্ষি নারদ, শম্ভু, সনৎকুমার, কপিলদেব, স্বায়ম্ভুব মনু, প্রহ্লাদ, জনক, ভীষ্মপিতামহ, বলিরাজ, শুকদেব এবং আমি (ধর্মরাজ যম) এ বারােজনই মাত্র জানি।"
ধর্মের এ শাশ্বত জ্ঞান সকলেই ধারণ করতে পারে না। এর জন্যে যোগ্য অধিকারী প্রয়োজন। তপ্তলোহা যেমন সকল পাত্রে রাখা যায় না, এর যোগ্য আধার হতে হয়। কাঠের পাত্রে রাখলে পাত্রে আগুন ধরে যায়; ঠিক তেমনি ধর্মকে ধারণ করার যোগ্য আধার হতে পারলে কিছুটা জানা যায়।ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদে প্রবর্তক ব্যক্তি তার অনুসারীদের নিজের সংকীর্ণ স্বার্থে যথেচ্ছাচার ব্যবহার করে ধর্মের পবিত্র নামকেই কলঙ্কিত করছে। তাই ধর্ম এবং কোন ঐতিহাসিক দিনে সংস্থাপিত ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যক্তিসর্বস্ব স্বেচ্ছাচারী মতবাদ এক নয়। এদের দুইয়ের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। একটি জীবাত্মার মত শাশ্বত সনাতন, অন্যটি দেহের মত নশ্বর। এ নশ্বর দেহটি যৌবনে যৌবনদীপ্ত, সচল এবং প্রচণ্ড শক্তিশালী থাকলেও; পরবর্তী সময়ে জীর্ণবস্ত্রের মতই পরিত্যক্ত হয়।এ জীর্ণবস্ত্রের মতই পরিত্যক্ত হওয়া পরিণতিকেই মৃত্যু বলে। কলিযুগের ছলধর্ম প্রসঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলা হয়েছে:
"পৃথিবীতে যত কথা ধর্ম নামে চলে।
ভাগবত কহে সব পরিপূর্ণ ছলে।।
ছলধৰ্ম ছাড়ি’ কর সত্যধর্মে মতি।"
শাস্ত্রানুযায়ী কলিযুগের ছলধর্ম থেকে আমাদের একান্ত মুক্ত হওয়া অত্যন্ত আবশ্যকীয়। তা না হলে ধর্ম নামক পরিপূর্ণ ছলনা আমাদের অজ্ঞাতসারে বিনাশ করে সত্যধর্ম থেকে বিচ্যুত করে দিবে। বর্তমান কলিযুগের তিনভাগ মিথ্যা এবং অবশিষ্ট একভাগ মাত্র সত্য। তাই মিথ্যা, অজ্ঞানের তামসিকতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে কালের প্রভাবে আমরা সত্যধর্মকে সর্বদা উপলব্ধি করতে না। ফলশ্রুতিতে আমরা শাশ্বত সত্যধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে যাই।বেদে ধর্মকেই সত্য বলা হয়েছে এবং সেই সত্যধর্মকেই পরমেশ্বরের স্বরূপ বলে বর্ণিত হয়েছে। শুক্লযজুর্বেদ সংহিতায় জীবন এবং জগতের ধারক পোষণকর্তা পরমেশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয়েছে, তিনি যেন অজ্ঞানের অন্ধকারে বদ্ধ হয়ে যাওয়া মনুষ্যের কাছে তাঁর সত্যধর্মরূপ স্বরূপ উন্মোচিত করেন।ধর্ম, সত্য, পরমেশ্বর অভিন্ন।
হিরণ্ময়েন পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্।
তত্ত্বং পূষন্নপাবৃণু সত্যধর্মায় দৃষ্টয়ে।।
(শুক্লযজুর্বেদ সংহিতা:৪০.১৫)
"সত্যধর্মের মুখ উজ্জ্বল হিরণ্ময় পাত্রের দ্বারা আবৃত। হে জীবন এবং জগতের ধারক সূর্য, তুমি কৃপা করে সেই আবদ্ধ পাত্রের মুখ উন্মোচিত করে দাও; যেন সত্যধর্মরূপ তোমাকে দর্শন করতে পারি।"
ধর্ম শাশ্বত সনাতন। স্বয়ং ঈশ্বর কর্তৃক প্রণীত হয়ে সৃষ্টির শুরু থেকেই ধর্ম বহমান। পক্ষান্তরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদ দিনতারিখ ও ভৌগোলিক চিন্তাচেতনার সংকীর্ণ গণ্ডিতে আবদ্ধ। 
 
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments