
এতদ্ধ্যেবাক্ষরং ব্রহ্ম এতদ্ধ্যেবাক্ষরং পরম্।
এতদ্ধ্যেবাক্ষরং জ্ঞাত্বা যো যদিচ্ছতি তস্য তৎ ।।
এতদালম্বনং শ্রেষ্ঠমেতদালম্বনং পরম্।
এতদালম্বনং জ্ঞাত্বা ব্ৰহ্মলোকে মহীয়তে।।
(কঠ উপনিষদ:১.২.১৬.১৭)
"এই ‘অক্ষরম্' হল (অউম্) সগুণ ব্রহ্ম। আবার এই ‘অক্ষরম্’কে নির্গুণ ব্রহ্মও বলা হয়। যে ব্যক্তি এই অউম্কে জানেন তাঁর সকল ইচ্ছা পূর্ণ হয়।
ব্রহ্মকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হল অউম্ (ওম্)। অপরা ব্রহ্ম (সগুণ) এবং পরা ব্রহ্ম (নির্গুণ) উভয়কেই এই পথে পাওয়া যায়। অপরা ব্রহ্মের সাধনার দ্বারা মানুষ ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়। এই লোকে মানুষ ব্রহ্মের সমমর্যাদা লাভ করে। পরা ব্রহ্মের দ্বারা মানুষ ব্রহ্মের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।"
ব্রহ্ম সগুণ এবং নির্গুণ দুই-ই হতে পারেন। সগুণ ব্রহ্মই সর্বভূতের অন্তরাত্মা। সগুণ ব্ৰহ্মই সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কারণ। ঈশ্বর, হিরণ্যগর্ভ ও বিরাট—এই তিনটি ব্রহ্মেরই আর এক নাম। প্রথম নামটি ব্রহ্মের নিমিত্ত বা কারণ অবস্থা, দ্বিতীয়টি ব্রহ্মের সূক্ষ্মাবস্থা এবং তৃতীয়টি ব্রহ্মের স্থূলাবস্থাকে সূচিত করে। ব্রহ্ম কিন্তু এক এবং অদ্বিতীয়। তাই এ গুণগুলি ব্রহ্মের ওপরে সামান্যতম প্রভাব বিস্তার করে না, গুণগুলি ব্রহ্মে আরোপিত মাত্র। ব্রহ্ম সদা নিত্য এবং অপরিবর্তনীয়। সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের জন্য বাংলা (ওঁ) এর বদলে, সর্বভারতীয় এবং সর্বভাষায় প্রযোজ্য (ॐ) -এ ওঙ্কার চিহ্নটি গ্রহণ করা হয়। এ সর্বভারতীয় ওঙ্কার চিহ্নটি দেবনাগরী লিপিতে ব্যবহৃত হলেও, কোন ভাষায় সীমাবদ্ধ না হয়ে ব্রহ্মবাচক ওঙ্কারের জন্য ব্যবহৃত স্বতন্ত্র একটি অক্ষর। যে অক্ষরটি শুধুমাত্র ওঙ্কারকে প্রকাশের জন্যই ব্যবহৃত হয়। তাই এই অক্ষরটি ওঙ্কারের প্রতীক হিসেবে সর্বত্রই ব্যবহৃত হয়। ওঙ্কারের প্রতীক হিসেবে (ॐ) - এই চিহ্নের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী।
ব্রহ্মবাচক ওঙ্কার (ॐ) চিহ্নের পরবর্তীতে, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের প্রতীকে চোখে পড়বে লাল-সবুজের একটি অত্যন্ত সুদৃশ্য বৃত্ত। সংগঠনটির যেহেতু বাংলাদেশে জন্ম হয়েছে, তাই মনোগ্রামে জ্যোতির্ময় ওঙ্কারের বলয়কে ঘিরে আছে, বাংলাদেশের পতাকার রঙে রাঙা প্রজ্জ্বলিত সূর্যের আকৃতির লাল সবুজের একটি বলয়। সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ পৃথিবীর যে দেশেই থাক না কেন, তারা তাদের মাতৃভূমিকে ভালবাসে। এ বিষয়টি একটি সর্বজনস্বীকৃত। প্রিয় মাতৃভূমিকে ভালবাসার এ মনা শিক্ষা সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ পেয়েছে, তাদের আদি ধর্মগ্রন্থ বেদ থেকে। অথর্ববেদসহ বেদের একাধিক স্থানে দেশপ্রেমের মন্ত্র রয়েছে। দেশপ্রেম বিষয়ক অথর্ববেদের অভ্যন্তরে 'পৃথিবীসূক্ত' নামে একটি বৃহৎসূক্তই রয়েছে। সেই পৃথিবীসূক্তে, মাতৃভূমিকে সুপথে প্রেরণ করার কথা বারেবারেই বলা হয়েছে। জন্মভূমির প্রতি সুতীব্র ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে।পৃথিবীতে বেদই বোধহয় একমাত্র ধর্মগ্রন্থ যেখানে মাতৃভূমির প্রতি কল্যাণের পথে, সত্যের পথে, থাকার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে একটি বৃহৎ অধ্যায়ই আছে। তাই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা পৃথিবীর যে দেশেই থাক না কেন, তারা মাতৃভূমির প্রতি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না। এর বড় দৃষ্টান্ত ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুক্ত। সেই মুক্তিযুদ্ধে সনাতন ধর্মাবলম্বী থেকে, নূন্যতম এক শতাংশ মানুষও দেশদ্রোহীতার সাথে যুক্ত ছিলেন না। বরং বহু সনাতন ধর্মাবলম্বী সাধুসন্তসহ সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধে দেশের জন্য জীবন আত্মাহুতি দিয়েছে। পক্ষান্তরে অন্যান্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের বিশাল একটি অংশ রাজাকারের খাতায় নাম লিপিবদ্ধ করে, দেশদ্রোহিতার সাথে যুক্ত ছিলেন ইতিহাস তার সাক্ষী। তাই পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ তাদের দেশকে ভালবাসে, মাতৃভূমিকে ভালবাসে। বেদমন্ত্রে বলা হয়েছে :
ভূমে মাতর্নি ধেহি মা ভদ্রয়া সুপ্রতিষ্ঠিতম।
সংবিদানা দিবা কবে শ্রিয়াং মা ধেহি ভূত্যাম।
( অথর্ববেদ : দ্বাদশ কাণ্ড, প্রথম অনুবাক)
"হে মাতৃভূমি, তুমি আমায় কল্যাণের পথে সদা সুপ্রতিষ্ঠিত কর। হে জ্ঞানস্বরূপা কাব্যময়ী মাতৃভূমি, তুমি দিনের আলোর ন্যায় আমায় উদ্ভাসিত করে সদা শ্রীযুক্ত এবং পশু-পাখি, মানব সহ পৃথিবীর সকল ভূতজগতের সাথে সদা যুক্ত রেখ।"
রামায়ণের মধ্যেও বলা হয়েছে, জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ। রামায়ণের অসংখ্য শিক্ষার মধ্যে অন্যতম একটি শিক্ষা হচ্ছে দেশপ্রেম। রামায়ণে পাওয়া যায়, দশানন রাবন বধের পরে লঙ্কা বিজিত হলে, লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্রকে বললেন, - দাদা,এমন সুন্দর স্বর্ণময়ী লঙ্কা যখন বিজিত হয়েছে, তখন আমরা মাতৃভূমি অযোধ্যায় ফিরে না গিয়ে এখানেই রাজত্ব করতে পারি। তখন উত্তরে শ্রীরামচন্দ্র বলেন হীরকখচিত দীপ্তিময় এক উক্তি," জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গের থেকেও শ্রেষ্ঠ"। উক্তিটিতে সুস্পষ্ট হয়েছে নিজ মাতৃভূমির প্রতি তীব্রতর ভালোবাসার কথা। এ উক্তিটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালের রাষ্ট্রীয় প্রতীকের মধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে। অবশ্য শ্লোকটি রামায়ণের বঙ্গ সংস্করণে পাওয়া যায় না।
অপি স্বর্ণময়ী লঙ্কা ন মে রোচতে লক্ষণ।
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।।
"লক্ষণ এই লঙ্কাপুরী যদিও স্বর্ণময়ী অতীব সুন্দরী, তবুও তা আমার কাছে রূচিকর নয়; কারণ জননী এবং জন্মভূমি স্বর্গ থেকেও অধিকতর শ্রেষ্ঠ।"
অবতার পুরুষ শ্রীরামচন্দ্রের ধর্মরক্ষা এবং দেশপ্রেমের আদর্শকে প্রত্যেকের জীবনে বাস্তবায়িত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। পৃথিবীর সকল আসুরিক শক্তিকে বিনাশ এবং শুভশক্তি, দৈবশক্তির উদ্বোধনে শ্রীরামচন্দ্রের নির্দেশিত পথে সর্বদা আমৃত্যু চলতে হবে। লাল-সবুজের দেশপ্রেমের বৃত্তকে ঘিরে আছে আরেকটি শ্বেত-শুভ্র বলয়। এ বলয়টি সত্ত্বগুণের প্রতীক। অর্থাৎ দৈবীমার্গে যেতে হলে বা মুক্তিলাভ করতে হলে সত্ত্বগুণকে ধারণ করে, তবেই মুক্তির পথে অগ্রসর হতে হবে। সত্ত্বগুণসহ ত্রিগুণ সম্পর্কে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে:
সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্ ৷৷
তত্র সত্ত্বং নির্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ৷৷
রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্।
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্মসঙ্গেন দেহিনম্৷৷
তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্বদেহিনাম্। প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত৷৷
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা:১৪.৫-৮)
"হে মহাবাহো ! সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ—প্রকৃতি হতে উৎপন্ন এই তিনটি গুণ অবিনাশী জীবাত্মাকে শরীরে আবদ্ধ করে।
হে নিষ্পাপ অর্জুন ! এই তিনটি গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্মল হওয়ায় প্রকাশশীল এবং বিকাররহিত,এই সত্ত্বগুণ আমি সুখী, আমি জ্ঞানী এই অভিমানে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে।
হে কৌন্তেয় ! রজোগুণ হল রাগাত্মক। এটি কামনা এবং আসক্তি থেকে উৎপন্ন হয়। এ জীবাত্মাকে কর্ম এবং ফলের নিমিত্ত আসক্তি দ্বারা বন্ধন করে।
হে অর্জুন ! সকল দেহাভিমানীর মোহকারক এই তমোগুণকে অজ্ঞান হতে উৎপন্ন বলে জানবে। এ জীবাত্মাকে প্রমাদ, আলস্য এবং নিদ্রার দ্বারা বন্ধন করে।"
সত্ত্বগুণের প্রতীক হিসেবে শ্বেতকায় বলয়ের পরবর্তীতে একটি বৃহত্তর গৈরিক রঙের বলয় রয়েছে। গৈরিক রঙ ত্যাগ-বৈরাগ্যের প্রতীক এবং জগতের কল্যাণের জন্য ত্যাগ বৈরাগ্যেই হিন্দুত্বের প্রতীক। সেই ত্যাগ-বৈরাগ্যের প্রতীক গৈরিক বলয়ের মাঝেই ইংরেজিতে সংগঠনের নাম 'Sanatan Vidyarthi Samsad' লেখা। ধর্মীয়, সামাজিক এবং সেবাব্রতী সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ সংগঠনটি একটি সময়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক স্তরে ছড়িয়ে পড়বে। এ মহান প্রত্যাশা নিয়েই সংগঠনটির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সেই ভবিষ্যৎ প্রত্যাশার লক্ষ্যেই, সংগঠনটির নাম আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ভাষা ইংরেজিতে। সমগ্র পৃথিবীর সকল মানবের মাঝে বৈদিক ধর্মের প্রচার প্রসঙ্গে বেদে বলা হয়েছে, বেদে শুধুই ঈশ্বরের মহিমাকে বর্দ্ধিত করতে অনার্য্যগণকে শিক্ষা প্রকৃত বৈদিক জ্ঞান দিয়ে শিক্ষিত করে তুলতে বলা হয়েছে। তাই সংগঠনটি পরমেশ্বরের নির্দেশ মাথায় নিয়ে জগতের সকলে মাঝে বৈদিক জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে।
ইন্দ্রং বর্ধন্তো অপ্তুরঃ কৃণ্বন্তো বিশ্বমার্য্যম্।
অপঘ্নন্তো অরাব্ণঃ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৯.৬৩.০৫)
"হে মনুষ্যগণ, তোমরা ঈশ্বরের মহিমাকে বর্দ্ধিত করতে স্বত্ত্বাপহারী অনার্য্যগণকে শিক্ষা দাও এবং সমগ্র বিশ্ববাসীকে আর্য করে তোল।"
সংগঠনের নামটি ইংরেজি ভাষায় লেখা হলেও, এর ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে 'Samarkan' নামক একটি ফন্ট। এ ফন্টটি দেখতে সংস্কৃত দেবনাগরী লিপির মত। এই ফন্টটির কারণে, হঠাৎ কেউ সংগঠনটির নাম সংস্কৃত দেবনাগরী লিপিতে লিখিত বলে মনে করে।কিন্তু পরবর্তীতে ভালো করে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, সংগঠনটির নাম সংস্কৃতে নয় ইংরেজি ভাষায় লেখা।আমরা যখন সংগঠনটির মনোগ্রাম গ্রহণ করি, সেই ২০১০ খ্রিস্টব্দে এ 'Samarkan' ফন্টটি অনেকটাই অপরিচিত ছিল। আমরা সংস্কৃতের মত দেখতে একটি ইংরেজি ফন্ট খুঁজতেছিলাম। তখন বেশ খুঁজে খুঁজে এ ফন্টটি সংগঠনের মনোগ্রামে গ্রহণ করা হয়। তাই সংগঠনের মনোগ্রামে হঠাৎ করে তাকালে মনে হয় সংস্কৃতে সংগঠনের নাম লেখা।গৈরিক বলয়ের মধ্যে অর্ধচন্দ্রের মত সংগঠনের নাম 'Sanatan Vidyarthi Samsad' নামটি লেখা। এ নামের শুরুতে এবং শেষে দুটি স্বস্তিকা চিহ্ন রয়েছে। সংগঠনের শুরুতে এবং শেষে উভয় স্থানেই 'স্বস্তিকা' চিহ্ন। স্বস্তিকা হল কল্যাণের প্রতীক, মঙ্গলের প্রতীক।ঋগ্বেদ সংহিতা সহ বেদের বিভিন্ন স্থানেই 'স্বস্তি' বা 'স্বস্তিকা' সম্পর্কিত বিবিধ মন্ত্র দৃষ্ট হয়।
স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ
স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ।
স্বস্তি নোস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ
স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।।
(ঋগ্বেদ ১.৮৯.৬)
"বৃদ্ধশ্রবা ইন্দ্র আমাদের মঙ্গল করুন; সকল জ্ঞানের আধার ও জগতের পোষক পূষা আমাদের মঙ্গল করুন; অহিংসার পালক তার্ক্ষ্য অরিষ্টনেমি এবং বৃহস্পতি আমাদের মঙ্গল করুন।"
গৈরিক বলয়ের উপরের অর্ধাংশে যেমন রয়েছে, সংগঠনের নাম; তেমনি অবশিষ্ট নিচের অর্ধাংশে রয়েছে সংগঠনের শাখার নাম। সাধারণত সংগঠনের মনোগ্রামটি অপরিবর্তনীয় হয় সকল শাখার জন্য। কিন্তু সমগ্র মনগ্রামটি অপরিবর্তনীয় হলেও, আমরা ইচ্ছা করেই মনোগ্রামে শাখার নামটি পরিবর্তনের বিধান রেখেছি। যেন প্রত্যেক শাখা যার যার নিজেদের শাখার নামটি মনোগ্রামের অভ্যন্তরে দেখে সংগঠনটিকে আরও বেশি বেশি করে আপন বলে মনে করে। তবে সংগঠনটির মনোগ্রামের বিন্দুমাত্র স্থানও পরিবর্তনীয় নয়, শুধু শাখার নামটি ছাড়া। এই স্বতন্ত্র শাখার নামটি দেয়ার আরেকটি কারণ রয়েছে। তা হল- এ সংগঠনটি একটি স্বতন্ত্র সেবাব্রতী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। কেউ কারো উপরে আধিপত্য না করে, সকল বিদ্যার্থীর সম্মিলনে সংগঠনটি মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে সদা ঐক্যবদ্ধ থাকা। সংগঠনটির লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য হল:
"১. হিন্দু সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করা।
২. সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালন ও সংরক্ষণ করা।
৩. সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মানবাধিকার রক্ষা এবং জাগতিক ও পারমার্থিক কল্যাণের জন্য সদা নিয়োজিত থাকা।"
সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের উদ্দেশ্য কেউ কারো উপরে কর্তৃত্ব বা আধিপত্য বিস্তার নয়। বরং হিন্দুত্বের বৈশ্বিক সর্বজনীন মানবতাবাদে উজ্জীবিত করা। সকলকেই বৈদিক একাত্ব মানবতাবাদী চিন্তা, দর্শন এবং কর্মের অনুগামী করা। আধুনিক সাম্যবাদের প্রধান লক্ষ্য হল অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সাম্যতা। কিন্তু সুপ্রাচীন বৈদিক সাম্যবাদ আরও গভীর, আরও সুস্পষ্ট এবং আরও বহুক্ষেত্রে প্রসারিত। তাই সেই বৈদিক সাম্যবাদের প্রচার প্রসার জগতের কল্যাণের জন্যও একান্ত আবশ্যক। বৈদিক সাম্যবাদ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদ সংহিতার সর্বশেষ সূক্তে বলা হয়েছে:
সং গচ্ছধ্বং সং বধ্বং সং বাে মনাংসি জানতাম্।
দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে॥
সমানাে মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্।
সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বাে হবিষা জুহােমি॥
সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।
সমানমন্ত বাে মনাে যথা বঃ সুসহাসতি॥
(ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২-৪)
"হে মানব, তােমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে একই ঐক্যের কথা বলো, তােমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হােক। পূর্বকালীন জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেমন করে কর্তব্য কর্ম এবং উপাসনা করেছে, তােমরাও তেমন করে আমার পথে চল।
তােমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হােক,
মিলনভূমি এক হােক এবং মনসহ চিত্ত এক হােক। তােমরা একতার মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে অগ্রগামী হও। তােমাদেরকে দেয়া খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করে গ্রহণ কর।
তােমাদের সকলের লক্ষ্য এক হােক, হৃদয় এক হােক এবং মন এক হােক। তােমরা সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও।"
সংগঠনের বলয়ের সম্পূর্ণ বলয়ের নিচে রয়েছে একটি খোলা বেদের প্রতিকৃতি। আমরা জাতি, ধর্ম এবং বর্ণ নির্বিশেষে এ বেদের প্রচার করতে চাই। যে নির্দেশনা বেদে স্বয়ং ঈশ্বর আমাদের দিয়েছেন।বেদের জ্ঞান কোন ব্যক্তিগোষ্ঠী বিশেষের মধ্যে আবদ্ধ নয়। বেদের জ্ঞান সর্বজনীন জগতের সকল মানবমাত্রেই বৈদিক জ্ঞানের অধিকারী। তাই প্রচারের মাধ্যমে বেদের জ্ঞান জগতের সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র, মিত্র ও শত্রু, আপন - পর; জগতের কোন মানবই যেন বেদজ্ঞান থেকে বঞ্চিত না হয় -এ নির্দেশনাটি বেদে স্বয়ং পরমেশ্বরই আমাদের দিয়েছেন।
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্মরাজন্যাভ্যাং শূদ্রায় চার্যায় চ স্বায় চারণায় চ।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ
ভূয়াসময়ং মে কামঃ সমৃধ্যতামূপ মাদো নমতু।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:২৬.২)
"আমি যেমন এই কল্যাণকারিণী বেদবাণী ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়,শূদ্র, বৈশ্য নির্বিশেষে সবাইকে বেদের জ্ঞান দান করেছি, তেমনি তোমরাও তোমাদের প্রিয়জন থেকে শত্রু সবাইকেই বেদের জ্ঞান প্রদান করে দেবতা সহ সকলের প্রিয় হও এবং পরিশেষে আমাকে প্রাপ্ত হও।"
বৈদিক আলো যেন আমাদের সবার মাঝে প্রবেশ করে এবং আমাদের বুদ্ধি যেন সর্বদা পরমেশ্বরের পথেই থাকে। এ আকাঙ্ক্ষা থেকেই মনোগ্রামের নিচের অংশে খোলা বেদের প্রতীকের মধ্যে বেদের সর্বশ্রেষ্ঠ মন্ত্র গায়ত্রী মন্ত্রের তৃতীয় বা শেষপাদকে স্থাপন করা হয়েছে। সেই তৃতীয় পাদে বলা হয়েছে, পরমেশ্বর যেন আমাদের বুদ্ধিকে তাঁর পথে প্রেরণ করেন। বৈদিক মন্ত্ররাজির মধ্যে হিরন্ময় অক্ষরে শোভিত একটি বাক্য এটি। এ কারণেই গায়ত্রী মন্ত্র দিনে ত্রিসন্ধ্যা প্রতিনিয়ত জপ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ বুদ্ধিকে দিনে তিনবার স্মরণ করিয়ে দেয়া যে, হে বুদ্ধি তুমি শুভ পথে চল এবং পরমেশ্বরের শাশ্বত পথে চল। তুমি কখনো বিভ্রান্ত হবে না।
ॐ ভূর্ভুবঃ স্বঃ
তৎ সবিতুর্বরেণ্যং
ভর্গো দেবস্য ধীমহি।
ধিয়ো যো নঃ প্রচোদয়াৎ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:৩.৬২.১০)
"সৃষ্টি, স্থিতি এবং লয়কর্তা; প্রাণস্বরূপ, দুঃখনাশক এবং স্বর্গীয় সুখস্বরূপ; জ্যোতির্ময়, সর্বরক্ষক বরণীয়, ঐশ্বর্যযুক্ত পরমাত্মার ধ্যান করি। সেই বরণীয় প্রেরণকর্তা যেন আমাদের বুদ্ধিকে শুভ কার্যে প্রেরণ করেন।"
মনোগ্রামের সর্বনিম্নে উন্মুক্ত বেদের নিচে রয়েছে একটি হলদে রঙের বৃত্ত। হলদে রঙ মায়া বা মোহের প্রতীক। এ হলদে বৃত্তের অভ্যন্তরে রয়েছে একটি রক্তিম বৃত্ত। এ রক্তিম বৃত্তটি রজোগুণের প্রতীক। আমরা অধিকাংশই আছি তমোগুণের অন্ধকারে নিমজ্জিত। সে অবস্থায় কখনই আমাদের হুট করে সত্ত্বগুণে পৌছানো সম্ভব নয়। আমাদের পর্যায়ক্রমে ধীরেধীরে সত্ত্বগুণে পৌঁছাতে হবে। তাই প্রথমে রজোগুণকে জাগাতে হবে। রজোগুণ ক্ষাত্রশক্তি, উদ্দীপনা ও বীরত্বের প্রবৃদ্ধি করে। যে ক্ষাত্রশক্তিতে দেশ, জাতি এবং ব্যবহারিক ধর্ম সুরক্ষিত হয়। রজোগুণের মধ্যে একটি বীরত্বব্যঞ্জক জোশ রয়েছে। এ জোশ সকল প্রকার হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা বা হীনমন্যতা এবং ক্লীবতাকে বিদূরিত করে।তাই জাতি রক্ষার্থে রজোগুণের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। রজোগুণ হলদে রঙের মায়া বা মোহের আবরণে আবদ্ধ থাকে। সত্ত্বগুণের বিকাশের মাধ্যমে সেই মোহের আবরণকে উন্মুক্ত করা যায়। তবেই ত্রিগুনাতীত পরমেশ্বরের সন্ধান পাওয়া যায়। হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা বা হীনমন্যতা এবং ক্লীবতা প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতায় বলা হয়েছে :
ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয়্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্য ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।
(শ্রীমদ্ভগবদগীতা: ০২.০৩)
"হে অর্জুন হৃদয়ের ক্ষুদ্র দুর্বলতা ত্যাগ করে উঠে দাঁড়াও; এমন ক্লীবতা কাপুরুষতা তোমার শোভা পায় না।"
বাংলাদেশে সংস্কৃত ভাষা বা দেবনাগরী লিপির ব্যবহার একদমই নেই বললে চলে। বাংলাদেশ উৎপন্ন সংগঠনের মধ্যে সনাতন বিদ্যার্থী সংসদই প্রথম সংগঠন যে সংগঠনের মনোগ্রামে দেবনাগরী লিপিতে বেদবাক্যকে গ্রহণ করা হয়েছে। এ ভূখণ্ডের প্রাচীন ভাষা সংস্কৃত। এ সংস্কৃত ভাষা থেকেই বাংলা ভাষায় ৯৪% শব্দের আগমন ঘটেছে । সংস্কৃত , তৎসম এবং অর্ধ-তৎসম এ তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় সংস্কৃত ভাষা থেকে প্রায় ৯৪% এর উপরে শব্দ এসেছে। এ কারণেই বাংলাকে সংস্কৃতের দুহিতা বলে। সংস্কৃত ভাষার সিন্ধুকের মধ্যেই বেদ-বেদান্তের জ্ঞান আচ্ছাদিত রয়েছে। তাই বেদ এবং বেদান্তের সম্যক জ্ঞান লাভ করতে হলে, সংস্কৃত ভাষার মহাসিন্ধুকের তালার চাবি হাতে থাকতে হবে।তবেই আমরা সেই চাবি দিয়ে মহাসিন্ধুকের তালাকে খুলে বৈদিক জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হতে পারব। পক্ষান্তরে যদি আমরা সেই সিন্দুকের তালাকে খুলতে না পারি, তবে আমরা কোন দিনই বেদ-বেদান্তের অনন্ত জ্ঞানের জগতে প্রবেশ করতে পারব না।
0 Comments