সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের একাদশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী


ভাবতে রোমাঞ্চিত লৎগছে ২০১০ সালে দীপান্বিতা অমাবস্যাতিথিতে কালীপূজার দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদল স্বপ্নবাজ উচ্চশিক্ষিত যুবকদের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয় সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ। সেই ২০১০ সালের সদ্যজাত সংগঠনটি আজ ২০২০ সালে এসে দেশের প্রায় সকল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের শতাধিক শাখার এক বর্ণাঢ্য বিশাল মহীরুহ বৃক্ষে পরিণত  হয়ে বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী শিক্ষিত সম্প্রদায়ের এক সর্ববৃহৎ সংগঠনে রূপান্তরিত।সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের লক্ষ্য ও

উদ্দেশ্য হল:


"১. হিন্দু সমাজে প্রচলিত সকল প্রকার কুসংস্কার দূর করে এক ঐক্যবদ্ধ জাতিতে পরিণত করা। 


২. সনাতন ধর্মীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির লালন ও সংরক্ষণ করা। 


৩. সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মানবাধিকার রক্ষা এবং জাগতিক ও পারমার্থিক কল্যাণের জন্য সদা নিয়োজিত থাকা।"


সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ শুধুমাত্র কোন একটি সংগঠনই নয়; এটা হলো কুসংস্কার মুক্তভাবে বেদ-বেদান্তের মূলে ফেরার আন্দোলন এবং যুগপৎ অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের এক ঐক্যবদ্ধ প্লাটফর্ম। সাকার-নিরাকার ; শাক্ত,শৈব,সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব এ পঞ্চমত সহ সনাতন ধর্মাবলম্বী সকল মতপথের চিন্তাই প্রতিফলিত সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের মাঝে। সাতটি মূলনীতির উপরে ভিত্তি করে সংগঠনটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সপ্ত মূলনীতি হল:


"১. এক অদ্বিতীয়, পরমেশ্বরই এ বিশ্বসংসার এবং সনাতন ধর্মের প্রবর্তক। তিনি সৎ, চিৎ (চিন্ময়) এবং আনন্দময়স্বরূপ। তিনি চিন্তার অতীত, সর্বশক্তিমান, সর্বব্যাপক, সর্বান্তর্যামী, সর্বজ্ঞ, অভয়, কৃপাময় এবং সৃষ্টি, পালন ও লয়কর্তা। একমাত্র তাঁরই শরণ নিতে হবে এবং তাঁরই উপাসনা করতে হবে।


২. জীবের চিন্তার অতীত এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মেরই ভিন্ন ভিন্ন গুণ ও শক্তির প্রতীকী প্রকাশ হলেন দেবতাগণ। তাই সাধক ভেদে সকল দেবতার উপাসনায় সাবাইকে শ্রদ্ধাশীল হতে হবে।


৩. বেদ পরমেশ্বর কর্তৃক প্রকাশিত মানব জাতির পূর্ণাঙ্গ সংবিধান। অপৌরুষেয় সত্যবিদ্যাময় এ গ্রন্থই সনাতন ধর্মের একমাত্র ভিত্তিস্বরূপ। তাই সর্বপ্রকার শাস্ত্রীয় সিদ্ধান্ত নির্ধারিত হবে পরমেশ্বরের নিঃশ্বাস স্বরূপ এ বেদের মাধ্যমে। বৈদিক জ্ঞানের সারাংশ ‘শ্রীমদ্ভগবদগীতা’ সর্বমান্য গ্রন্থ এবং ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ অনুরূপ মর্যাদা পাবে।


৪. সনাতন ধর্মে অনাদি অনন্ত ব্রহ্মের উপাসনা পঞ্চমতে ও পথে বিভজিত যথা- শাক্ত, শৈব, সৌর, গাণপত্য এবং বৈষ্ণব। এর মধ্যে বাংলাদেশে প্রধানত শাক্ত, শৈব ও বৈষ্ণব তিনটি মত-পথের সম্প্রদায় বিদ্যমান। নিজ নিজ উপাস্য সম্প্রদায় ব্যতীত এ পঞ্চমতের সকল সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধা পোষণ করতে হবে। পক্ষান্তরে কোন আন্তঃসম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ মনোভাব পোষণ করা যাবে না।


৫. সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলের জন্য ‘এক ধর্ম (সনাতন), এক মত (বৈদিক), এক পরিচয় (হিন্দু)’ এই মূলমন্ত্রে বিশ্বাস করতে হবে।


৬. ব্যক্তিকেন্দ্রিক ধর্মীয় মতবাদের ততটুকুই গ্রহণযোগ্য যতটুকু বেদানুমোদিত। তবে বেদানুগত সকল মহামানবের প্রতিই সংযত শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে।


৭. সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল একটি স্বতন্ত্র, ধর্মীয়-সামাজিক, সেবাব্রতী সংগঠন।"


তবে গত দেড়শত বছরে বাংলায় যেভাবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্বেচ্ছাচারী মতবাদের জন্ম হয়েছে এতে দেশের অধিকাংশ শিক্ষিত হিন্দু সম্প্রদায়ই বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত এবং ক্ষুব্ধ। এ ব্যক্তিকেন্দ্রিক মতবাদের অনুসারীদের কারণেই নিজেদের মধ্যে মতান্তর হয়ে  হিন্দু সমাজের একতা দিনে দিনে নষ্ট হয়ে ক্ষয়িষ্ণু হয়ে যাচ্ছে। এই নবীন বক্তিসর্বস্ব ছোট গ্রুপগুলো অন্য হিন্দুদের দূরে থাক তারা তাদের নিজ গুরুপন্থীদের পর্যন্ত ঐক্যবদ্ধ করতে পারছে না। পরিনামে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র উপদলে দিনেদিনে তারা বিভক্ত হয়ে পরছে। বাঙালি হিন্দুদের তুর্কী শাসকদের ধর্মান্তরিত হওয়ার হাত থেকে যিনি নিশ্চিত রক্ষা করেছেন শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩)।সেই বাঙালীর প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেবের তিনটি বাণী আজ আমার মনে পরছে। তিনি বলেছেন, "কলিযুগে সংঘশক্তিই একমাত্র প্রধান শক্তি।" অর্থাৎ কলিযুগে সংঘশক্তির ফলেই সকল অধিকার অর্জন সম্ভব। এ কারণে সকলের উচিত এ যুগে আত্মকেন্দ্রিক বিচ্ছিন্ন না থেকে কোন একটি সংগঠনের সাথে সংঘবদ্ধভাবে থাকা। বেদে সুস্পষ্টভাবে সকল মানবকে ব্যক্তিজীবন থেকে সামাজিক জীবন, আধ্যাত্মিক জীবন সকল ক্ষেত্রেই একতাবদ্ধের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে:


সং গচ্ছধ্বং সং বধ্বং সং বাে মনাংসি জানতাম্। 

দেবা ভাগং যথা পূর্বে সঞ্জানানা উপাসতে॥ 

সমানাে মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং মনঃ সহ চিত্তমেষাম্। 

সমানং মন্ত্রমভিমন্ত্রয়ে বঃ সমানেন বাে হবিষা জুহােমি॥ 

সমানী ব আকুতিঃ সমানা হৃদয়ানি বঃ।

সমানমন্ত বাে মনাে যথা বঃ সুসহাসতি॥ 

(ঋগ্বেদ ১০.১৯১.২-৪)


"হে মানব, তােমরা একসঙ্গে চল, একসঙ্গে মিলে একই ঐক্যের কথা বলো, তােমাদের মন উত্তম সংস্কারযুক্ত হােক। পূর্বকালীন জ্ঞানী ব্যক্তিরা যেমন করে কর্তব্য কর্ম এবং উপাসনা করেছে, তােমরাও তেমন করে আমার পথে চল।


তােমাদের সকলের মিলনের মন্ত্র এক হােক,

মিলনভূমি এক হােক এবং মনসহ চিত্ত এক হােক। তােমরা একতার মন্ত্রে উদীপ্ত হয়ে অগ্রগামী হও। তােমাদেরকে দেয়া খাদ্য-পানীয় ঐক্যবদ্ধভাবে সুষম বণ্টন করে গ্রহণ কর।


তােমাদের সকলের লক্ষ্য এক হােক, হৃদয় এক হােক এবং মন এক হােক। তােমরা সর্বাংশে সম্পূর্ণরূপে ঐক্যবদ্ধ হও এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হও।"


বাংলাদেশে আমরা সংখ্যালঘু। সংখ্যাধিক্য নয়, আমাদের নিজদের যোগ্যতা এবং নিজ সংস্কৃতির গৌরব এবং স্বাভিমান দিয়েই নিজেদের স্বতন্ত্রতা জানাতে হবে। আগে নিজের জীবনকে সার্থক করতে হবে, এরপরে পরিবার এবং পরিশেষে বৃহৎ পরিবাররূপ জাতির সামর্থ্যানুযায়ী সেবা। শ্রীচৈতন্যদেবের ভাষায়, "নিজজন্ম সার্থক করি কর, পর উপকার।" আমি আমি যদি আমার নিজের জীবনকে সার্থক করতে না পারি, তবে অন্যের উপকার কি করে করব? আমি যদি বা আমার জীবন যদি অন্যের জন্যে বোঝা হয়ে যায় এবং অন্যকে যদি আমার ভার বহন করতে হয় ; তবে কি করে আমি মানুষের উপকার করবো? এ অবস্থায় কখনই মানুষের উপকার করতে পারব না। তাই সর্বপ্রথমে আমাদের নিজের জন্ম সার্থক করেই, তবে অন্যের উপকারচিন্তা করতে হবে।আমাদের প্রত্যেককেই এমন একটি বটবৃক্ষের মত হতে হবে যেন, সেই বৃক্ষে হাজার হাজার পাখি আশ্রয় নিতে পারে। বটবৃক্ষের মত হতে পারলে,তবেই মানুষের কল্যাণ করতে পারব। তখনই শ্রীচৈতন্যদেবের এ কথাটি সার্থক হবে। বেদের মাঝে সংজ্ঞানসূক্ত সহ অসংখ্য স্থানে সাম্যবাদের কথা আছে। বেদে সকল মানবকে একটি সাম্যবাদী ঐক্যসূত্রের নির্দেশনা দেয়া আছে। এ বৈশ্বিক সাম্যবাদই সারা পৃথিবীর সকল নগরাদি গ্রামে প্রচার করতে বলেছেন শ্রীচৈতন্যদেব। সকল মানবের মাঝে বৈদিক সাম্যবাদী ভাবাদর্শ প্রচার প্রসঙ্গে বলেছেন:


"পৃথিবীতে যত আছে নগরাদি গ্রাম।

সর্বত্র প্রচারিত হইবে মোর এই নাম।।"


সবাইকে পবিত্র দীপাবলি, শ্রীশ্রীশ্যামাপূজা এবং সনাতন বিদ্যার্থী সংসদের একাদশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভেচ্ছা!


কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী 

সহকারী অধ্যাপক, 

সংস্কৃত বিভাগ, 


চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Post a Comment

0 Comments